ইখতিয়ারুদ্দীন খলজীর অভিযানের পর থেকে তুর্কী-আফগানরা বাংলা অঞ্চলে ক্ষমতা বিস্তার করতে থাকে। ইলিয়াস শাহী বংশ গোটা বাংলাকে একত্র করে পূর্ব ভারতের সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী সাম্রাজ্যে পরিণত করেছিল। বাংলার বিজয়রথ ছুটেছিল বিহার, ঊড়িষ্যা, ঝাড়খণ্ড, কুচবিহার, আসাম, কাছাড়, ত্রিপুরা আর আরাকানে। ক্রমাগত অন্তর্দ্বন্দ্ব আর যুদ্ধ-বিগ্রহে বাংলার বিক্রম বরাবর বজায় থাকেনি। ১৫২৯ সালে নসরত শাহ মুঘল সম্রাট বাবরের সাথে শান্তিচুক্তি করে প্রায়-স্বাধীন সুলতান হিসেবে বাংলা শাসন করতে থাকেন। পরে শের খান বাংলা দখল করে নিজের সাম্রাজ্যভুক্ত করে ফেলেন। বাংলার সুলতানদের শাসনামল ছিল ষড়যন্ত্র আর বিদ্রোহে ভরপুর। দিল্লীওয়ালারা এ অঞ্চলকে বলত বুলগাকপুর বা বিদ্রোহের নগরী। যে কেউ সুলতানকে খুন করে ক্ষমতা দখল করতে পারত। ২৩৬ বছরে অন্তত ৬০ জন স্বাধীন সুলতান বাংলা শাসন করেন। প্রবাদ আছে, অন্তত তিন দিনের জন্য সিংহাসন দখলে রাখতে পারলেই সুলতান উপাধি পাওয়া যেত। এমনকি আবিসিনিয়ার অধিবাসী, যাদেরকে দাস হিসেবে বাংলায় আনা হয়েছিল; তারাও প্রভুদের হত্যা করে কিছুদিন রাজাসন দখলে রেখেছিলেন।
কররানী বংশের উত্থান ও দাউদ খান
কররানীরা মূলত বর্তমান পাকিস্তানের খাইবার-পাখতুনওয়া এবং পূর্ব আফগানিস্তানের অধিবাসী। শের শাহের পুত্র ইসলাম শাহের মৃত্যুর পর দিল্লীর আফগান/পাঠান শাসন দুর্বল হয়ে পড়ে। ১৫৬৪ সালে গুজরাটের আদিল শাহের হাতে অপমানিত হয়ে এই জাতির এক সেনাপতি তাজ খান, বিহারে তার ভাই সোলায়মানের কাছে চলে আসেন। তাজ ও সোলায়মান বাংলার সিংহাসন হস্তগত করেন। ১৫৬৫ সালে তাজ খানের মৃত্যুর পর সোলায়মান কররানী বাংলা ও বিহারের অনেক এলাকার নিয়ন্ত্রণ পেলেও নিজেকে সরাসরি স্বাধীন ঘোষণা করেননি।
তিনি মুঘল সম্রাট আকবরের বশ্যতা স্বীকার করতেন ও তার নামে খুতবা পড়াতেন। সোলায়মানের সেনাপতি কালাপাহাড় ও বড় ছেলে বায়েজীদ ঊড়িষ্যা জয় করেন। কালাপাহাড়ের ধ্বংসকীর্তি আজও বিভীষিকা হিসেবে মনে রাখা হয়েছে। সোলায়মান কুচবিহারকেও বশ্যতা স্বীকার করিয়েছিলেন। ১৫৭২ সালে তার মৃত্যুর পর বায়েজীদ সিংহাসনে বসেন ও কয়েক মাসের মাথায় ভগ্নীপতি হানসু দ্বারা নিহত হন। সোলায়মানের উজির লোদি খান হানসুকে হত্যা করলে সোলায়মানের ছোট ছেলে দাউদ খান কররানী সিংহাসনে বসেন। বায়েজীদ ও দাউদ দু’জনেই নিজেদের সম্পূর্ণ স্বাধীন বলে ঘোষণা করে নিজেদের নামে খুতবা ও মুদ্রা চালু করেছিলেন।
স্বভাব ও সেনাবাহিনী
সুলতান দাউদ খান কররানী (১৫৭৩-১৫৭৬) ছিলেন অহংকারী, উদ্ধত কিন্তু ভীতু স্বভাবের মানুষ। সুদর্শন সুলতান আমোদ-প্রমোদ ভালোবাসতেন। কথিত আছে, সুলতানের সেনাবাহিনীতে বিশ হাজার কামান, এক লক্ষ চল্লিশ হাজার পদাতিক, চল্লিশ হাজার অশ্বারোহী, তিন হাজার হাতি আর অসংখ্য যুদ্ধনৌকা ছিল। বাংলার নৌবাহিনী আর গোলন্দাজদের প্রশংসা খোদ বাবরের আত্মজীবনীতেও দেখা যায়। গুর্জর খান, কতলু খান, জুনায়েদ খান বা কালাপাহাড়ের মতো দুর্ধর্ষ সেনাপতি আর শক্তিশালী সেনাবাহিনী নিয়েও দাউদ খান যে বার বার হেরে গিয়েছেন, এটা তার ব্যর্থতা। মানুষ চিনতেও তিনি ভুল করেছিলেন, বিশ্বস্ত উজির লোদি খানকে তারই নির্দেশে হত্যা করা হয়।
পাটনা যুদ্ধ ও পলায়ন
দাউদ খান কররানী সিংহাসনে বসে দেখলেন, রাজকোষ ধনসম্পদে ঠাসা, বিরাট সেনাবাহিনীও প্রস্তুত। তিনি উত্তর প্রদেশের জমনিয়া শহর আক্রমণ করে মাটির সাথে মিশিয়ে দেন। মুঘল সম্রাট আকবর তখন জৌনপুরের শাসক মুনায়েম খানকে দাউদের বিরুদ্ধে পাঠান। দাউদ বিশ হাজার সৈন্যসহ পাটনা দুর্গে আশ্রয় নেন। মুঘলদের তুমুল আক্রমণ সত্ত্বেও পাটনা দুর্গ কয়েকমাস প্রতিরোধ বজায় রাখে। তুমুল বর্ষার মধ্যে আচমকা সম্রাট আকবর স্বয়ং বিরাট সৈন্যদল নিয়ে পাটনা হাজির হলেন। পাটনা দুর্গের খাদ্য ও বারুদের সরবরাহ আসত গঙ্গার অপর তীরের হাজিপুর থেকে।
তিন হাজার মুঘল সৈন্য তীব্র যুদ্ধের পর হাজিপুর দখল করে নেয়। হাজিপুরের শাসক ফতেহ খানসহ অনেক সৈন্যের মাথা কেটে নৌকায় বোঝাই করে পাটনা দুর্গে পাঠানো হয়। দাউদ খান ভয় পেয়ে গেলেন। তিনি নৌকা নিয়ে পালালেন, এদিকে তার বিরাট সেনাবাহিনীর একাংশ মুঘল আক্রমণে ধ্বংস হলো। বহু হাতি আর কামান মুঘলদের হাতে পড়ল। দাউদ বাংলার প্রবেশপথ তেলিয়াগিরিতে দুর্গ ও সৈন্য মোতায়েন করে কররানীদের রাজধানী তাণ্ডায় ফেরত গেলেন। হাজিপুরের সৈন্যদের করুণ পরিণতি দেখে আফগান সেনারা তেলিয়াগিরি বিনা যুদ্ধে ছেড়ে দেয়। দাউদ খান ঊড়িষ্যায় পালান। রাজধানী তাণ্ডা মুঘলদের দখলে চলে যায়। রাজা টোডরমল আর মুনায়েম খানের নেতৃত্বে মুঘল বাহিনী ঊড়িষ্যার দিকে অগ্রসর হতে থাকে।
তুকারয়ের যুদ্ধ
সেকালে ঊড়িষ্যা ছিল সুলতানী বাংলার শেষ সীমা। দাউদ পরিখা খুঁড়ে প্রকাণ্ড সেনাদল গঠন করে অপেক্ষা করতে লাগলেন। তুকারয়ের প্রান্তরে ১৫৭৫ সালে পাঠান আর মুঘল সেনাদল মুখোমুখি হলো। দাউদের হাতে ছিল দু’শো হিংস্র রণহস্তী। এদের ওপর পাঠানদের বড় রকমের আশা ভরসা ছিল। বিপরীতে মুঘলদের ছিল অনেকগুলো ছোট আর হালকা কামান, এগুলি আবার ষাঁড়ে টানা গাড়ির ওপর বসানো থাকত। দাউদের হস্তী আক্রমণ এসব কামানের মুখে ব্যর্থ হয়, ভীত হাতির পাল উল্টে পাঠান সেনাদলকে বিপর্যস্ত করে পালিয়ে যায়। তবে পাঠানরা হতোদ্যম না হয়ে বিপুল বিক্রমে আক্রমণ করে মুঘলদের সামনের সারি চুরমার করে দেয়। মুঘল সেনাপতি খান-ই-আলম নিহত হন। মুনায়েম খান আহত হলেও তার ঘোড়া তাকে বাঁচিয়ে দেয়। গুর্জর খানের আক্রমণে মুঘল কেন্দ্রের সৈন্যরা পাঁচ মাইল হটে গেলেও দাউদ তাদের ধাওয়া না করে ইতস্তত করতে থাকেন। তিনি ভেবেছিলেন, এটা নিশ্চয়ই মুঘলদের কোনো ফাঁদ। আফগানরা মুঘলদের ডানদিকে তীব্র আক্রমণ চালিয়ে কিছু সফলতা পেলেও দাউদের সিদ্ধান্তহীনতা যুদ্ধের ফল পালটে দেয়। এ অবসরে মুঘলদের বামদিকের সেনারা, নেতৃত্বে টোডরমল, ভয়ংকর আক্রমণ চালায়। ওদিকে দাউদের অন্যতম সেনাপতি গুর্জর খান তীরবিদ্ধ হয়ে নিহত হলে পাঠানরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। দাউদ যথারীতি পালালেন। প্রচুর মুঘল সৈন্য এ যুদ্ধে নিহত হওয়ায় ঐ অঞ্চলের নামই হয়ে গিয়েছিল মোগলমারী। দাউদ পালিয়ে কটকে যান এবং মুনায়েম খানের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। মুনায়েম খান দাউদকে ঊড়িষ্যার শাসক ও মিত্র হিসেবে মেনে নেন।
বিদ্রোহ এবং মৃত্যু
মুনায়েম খান বাংলার প্রাচীন রাজধানী গৌড়ে গিয়ে সেখানেই বসবাস করতে থাকেন। সেখানে প্রবল মহামারিতে মুঘলদের বহু সৈন্যসহ খোদ মুনায়েম খানের মৃত্যু হয়। সুযোগ বুঝে দাউদ খান বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। ভদ্রকের যুদ্ধে মুঘলদের হারিয়ে দাউদ রাজমহলে পৌঁছুলেন, অন্য আফগান দলগুলোও তার সাথে যোগ দিলো।মুনায়েম খানের মৃত্যুর পর হোসেন কুলি খানকে বাংলার সুবাদার নিযুক্ত করা হয়, সাথে যোগ দেন রাজা টোডরমল। ওদিকে বিহারের মুঘল শাসনকর্তা মজঃফর খানও বিরাট সেনাদল নিয়ে এগুতে থাকেন। দাউদ খান পঞ্চাশ হাজার অশ্বারোহী নিয়ে রাজমহলে অবস্থান নিলেন। তেলিয়াগিরিতে আফগানদের প্রবল প্রতিরোধ চূর্ণ করে মুঘলরা এগিয়ে এল। ১৫৭৬ সালে রাজমহলে এক তীব্র যুদ্ধের পর বাংলার সুলতান পরাস্ত হন।
কতলু খান মুঘলপক্ষে যোগ দেন, কালাপাহাড় এবং জুনায়েদ খান নিহত হন। দাউদ খানের ঘোড়ার পা মাটিতে বসে গেলে তিনি ধরা পড়েন।হোসেন কুলি খানের প্রশ্নের জবাবে উদ্ধত দাউদ জানান, মুনায়েম খানের মৃত্যুর সাথে সাথে মুঘলদের সাথে শান্তিচুক্তিও বাতিল হয়েছে, তার বিদ্রোহ ন্যায়সঙ্গত। হোসেন কুলি সম্ভবত দাউদকে ক্ষমা করতে রাজি ছিলেন, কিন্তু অনেকের ধারণা, দাউদ কথাবার্তার ছলে লুকানো ছোরা দিয়ে হোসেন কুলীকে খুনের মতলব করছিলেন। পাঠানের শঠতায় ক্ষুব্ধ হয়ে অন্যান্য মুঘল সৈন্যরা দাউদকে খুন করে। বাংলার শেষ স্বাধীন সুলতানের মাথা কেটে আকবরের কাছে পাঠানো হয়। ঊড়িষ্যায় পালাবার পথে দাউদ তার কোষাধ্যক্ষ হরিদাস ওরফে বিক্রমাদিত্যকে বিপুল ধনসম্পদ নিরাপদে কোথাও নিয়ে যেতে বলেছিলেন। এসব সম্পদের বদৌলতে হরিদাস শক্তিশালী যশোর সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন। হরিদাসের ছেলে প্রতাপাদিত্য পরবর্তী সময়ে মুঘলদের বিরুদ্ধে জোর লড়াই চালিয়েছিলেন।
The article is in Bengali language. This is about Sultan Daud Khan Karrani, the last independent sultan of Bengal Sultanate.
References: 1. মুঘল সাম্রাজ্যের উত্থান-পতনের ইতিহাস, অনিরুদ্ধ রায়, প্রগতিশীল প্রকাশক, কলকাতা
2. চার্লস স্টুয়ার্ট, বাংলার ইতিহাস (অনুবাদক আবু জাফর), ২০০৯, হাক্কানী পাবলিশার্স, ঢাকা
3. কালীপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায়, মধ্যযুগে বাংলা, ২০০২, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা
4. রজনীকান্ত চক্রবর্তী, গৌড়ের ইতিহাস, ১৯৯৯, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা
Featured Image: Live History India