পলাশী যুদ্ধের আদ্যপ্রান্ত

Date:

Share post:

পলাশী যুদ্ধের আদ্যপ্রান্ত

পলাশী যুদ্ধ বাংলার ইতিহাসে যেমন গুরুত্বপূর্ণ ঠিক তেমনি বিসিএস সহ সকল ধরণের চাকরির পরীক্ষার জন্যও অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়।

বাণিজ্যের আকর্ষণেই ইউরোপীয়রা দীর্ঘকাল পূর্বে ভারতে আসে এবং ক্রমশ এদেশের রাজনীতিতে তারা তাদের আধিপত্য বিস্তারে সচেষ্ট হয়। বাণিজ্যের কথা বিবেচনা করে বলা যায় যে, এই অঞ্চলের পণ্য দ্রব্যের ব্যাপক চাহিদা ছিল সমগ্র ইউরোপে বিশেষ করে ইংল্যান্ডে। স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে, কলম্বাস এদেশ আবিষ্কারের উদ্দেশেই এককালে সমুদ্রযাত্রা করেছিলেন, যদিও শেষ পর্যস্ত তিনি আবিষ্কার করে ফেলেন আমেরিকা। ইতিহাস থেকে আরও জানা যায় যে,পর্তুগিজ নাবিক ও বেনিয়া ভাস্কো দা গামা ভারতে পৌঁছেছিলেন ১৪৯৮ সালে। এই পতুর্গিজদের সূত্র ধরেই একের পর এক বাণিজ্য কুঠি পূর্ব ভারতসহ ভারতের বিভিন্ন অংশে স্থাপিত হতে থাকে। এরা দুস্যবৃত্তিতেও লিপ্ত ছিল। এদের নিয়ন্ত্রণ ও দমন করতে তৎপর হন মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীর।

আরও উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, তাঁর অনুমতি পেয়েই ইংল্যান্ডের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রথম সুরাটে বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করে। বলা যেতে পারে, এই আপাত ক্ষুদ্র ঐতিহাসিক ঘটনাটিই মূলত ভারতের পরবর্তীকালের ইতিহাসকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। ইতিহাস থেকে আরও জানা যায় যে, ১৬৩২ সালে বাংলার সুবাদার যুবরাজ শাহ সুজার সম্মতি পেয়ে ইংরেজরা হুগলিতে কারখানা স্থাপনের অনুমতি পায়। এর ধারাবাহিকতায় ১৬৯৮ সালে ইংরেজরা সুতানটি গোবিন্দপুর ও কলিকাতা গ্রাম ক্রয় করে এবং উল্লিখিত এই তিনটি গ্রাম নিয়েই পরে কলিকাতা নগরী গড়ে ওঠে। এর কাছাকাছি সময়ে আরও একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে। মরণাপন্ন মোগল সম্রাট ফররুখ শিয়রকে শল্য চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ করে তোলেন ইংরেজ ডাক্তার হ্যামিলটন৷ আর এরই পুরস্কার হিসেবে ডাক্তারের অনুরোধে ইংরেজদের এদেশে অবাধ বাণিজ্যের ফরমান প্রদান করেন সম্রাট; যা ইংরেজদের বিনা শুল্কে বাণিজ্য, জমিদারি লাভ, নিজস্ব টাকশাল স্থাপন, এমনকি দেশীয় কর্মচারীদের বিচার করবার ক্ষমতাও প্রদান করে।

তবে, দিল্লি থেকে এমন ফরমান জারি হলেও বাংলার শাসনকর্তা মুর্শিদকুলি খাঁ, সুজাউদ্দিন খাঁ, সরফরাজ খাঁ এবং আলিবর্দি খাঁ তাদের নিজনিজ এলাকায় এতটাই শক্তিশালী ছিলেন যে, তারা কেউই বাদশার এই অন্যায় ফরমান মানেননি। আর এ থেকেই ইংরেজদের সঙ্গে বাংলার নবাবদের ঘনঘন সংঘর্ষ, লড়াই চলতে থাকে। এই সকল লড়াইয়ে ইংরেজরা বারংবার পরাভূত হয়েছে। অন্তত, নবাব আলিবর্দি খাঁ-র শাসনামল পর্যন্ত এসকল লড়াই খুব একটা ব্যাপকতা লাভ করেনি; তবে ভেতরে ভেতরে নানা রকম ষড়যন্ত্র চলছিল। কিন্তু পরিস্থিতির প্রয়োজনে অতি অল্প বয়সে সিরাজউদ্দৌলা সিংহাসনে আরোহণের পর থেকেই ইংরেজরা সিরাজের বিরুদ্ধে ব্যাপকভাবে একের পর এক লড়াই ও ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। ইংরেজদের এই ষড়যন্ত্রে সামিল হয় ফরাসিরাও| কেননা, বাণিজ্য কুঠি স্থাপনের সূত্র ধরে ফরাসিদেরও নানারকম স্বার্থ বড় হয়ে দেখা দেয়।

বাণিজ্যের সূত্রে প্রথমে ফরাসি ও ইংরেজদের মধ্যে রেষারেষি তৈরি হলেও পরবর্তী পর্যায়ে তারা একে অপরের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সিরাজের বিরুদ্ধে গোপন ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করতে সক্ষম হয়। এদিকে দিল্লির শাসনব্যবস্থা সেসময়ে দুর্বল থাকায় মারাঠা বর্গি, পারস্যরাজ নাদির শাহ, আফগান শাসনকর্তা আহমদ শাহ আবদালি প্রমুখের আক্রমণে গোটা দেশ জুড়েই অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছিল। এই পরিস্থিতির সুযোগে ইংরেজ ও ফরাসিরা তাদের চক্রান্ত বাস্তবায়নে অগ্রসর হয়। ইংরেজদের ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে তারা দেশীয় স্বার্থপর লোভী বেনিয়া মুৎসুদ্দিদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে। দেশীয় এসব ব্যক্তির কাছে নিজেদের স্বার্থ সংরক্ষণই শেষ কথা ছিল; তাতে দেশের ক্ষতি হলো-কি না হলো সে বিষয়ে কোনো চিন্তা ছিল না। এমনকি দেশের স্বাধীনতা বিসর্জনেও তারা পিছ-পা হয়নি। বলা প্রয়োজন যে, নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ কিংবা নবাব আলিবর্দি খাঁ কেউই তাদের শাসনামলে এসব পুঁজিপতি কিংবা বিদেশি বেনিয়াদের কোনোরকম কোনো প্রশ্রয় দেননি।

সিরাজ নবাব হওয়ার পর তিনিও একইভাবে পূর্বসূরিদের পদাঙ্ক অনুসরণ করেন। নবাব সিরাজউদ্দৌলা ছিলেন বয়সে তরুণ। তিনি ইংরেজদের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। তবে ফরাসিদের প্রতি তার প্রশ্রয় ছিল বলে কোনো কোনো ইতিহাসবেস্তা মনে করেন। কিন্তু সিরাজের সামনে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়ায় প্রাসাদ ষড়যন্ত্র। নবাবের অধিকাংশ অমাত্য ও সেনাপতি অর্থ ও ক্ষমতার লোভে নবাবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। মিরজাফর আলি খাঁ নিজেই নবাব হওয়ার লোভে হাত মেলান রাজা রাজবল্লভ, জগৎশেঠ, রায়দুর্লভ প্রমুখ বিশ্বাসঘাতক ষড়যন্ত্রকারীদের সঙ্গে। এমনকি নবাবের খালা ঘসেটি বেগমও নিজ পুত্রস্নেহে অন্ধ হয়ে নবাবের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন এবং ষড়যন্ত্র সফল করার জন্য অর্থ ব্যয় করেন।

এই ধারাবহিকতায় ১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দের ২৩এ জুন পলাশির প্রান্তরে ইংরেজদের বিরুদ্ধে নবাব যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। ইংরেজদের তুলনায় নবারের অস্ত্র, গোলা-বারুদ, সৈন্য সবই বেশি ছিল। ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, ইংরেজদের পক্ষে ছিল তিনহাজার সৈন্য এবং আটটি কামান; এর বিপরীতে নবাব পক্ষের সৈন্যসংখ্যা ছিল পঞ্চাশ হাজার এবং কামানের সংখ্য ছিল তেপ্পান্নটি। এত বিপুল সমর-সাম্য থাকা সবে নবাবের পরাজয় হলো, কেননা তাঁর অধিকাংশ সেনাপতি যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করে নিষ্ক্রিয় হয়ে রইল । এভাবে এক অন্যায় যুদ্ধে বাংলা ইংরেজদের অধীন হলো।

ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে বিশ্বাসঘাতক পুঁজিপতি আর সেনাপতিরা বাংলার স্বাধীনতা বিসর্জন দিল। সিরাজের এই পরাজয়ে তাঁর সমরশক্তির কোনো অভাব ছিল না; কেবল অভাব ছিল নিকটজনের সততা ও আন্তরিকতার। এই পরাজয় একান্তভাবেই রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণে ঘটেছিল। পলাশির যুদ্ধে জয়লাভের সূত্রে ইংরেজরা দিল্পির সম্রাট ফররুখ শিয়র প্রদত্ত সেই ফরমান কার্যকর করতে সক্ষম হলো। এভাবেই বাংলার রাজনীতি ও অর্থনীতিতে ইংরেজরা একাধিপত্য প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হলো।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_img

Related articles

Prepositional Phrase কাকে বলে? চেনার উপায়।

যে Phrase বা শব্দ সমষ্টি Preposition এর কাজ করে তাকে Prepositional Phrase বলে। Preposition মূলত: Noun / Noun equivalent...

Gerund কাকে বলে? চেনার উপায় এবং এর ব্যবহার।

বাক্যে যে Verb এর শেষে ing যুক্ত হয়ে যে Verb একই সাথে Verb ও Noun-এর কাজ করে থাকে...

৪৬তম বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষা ০৯ মার্চ

8৬তম বি.সি.এস পরীক্ষা-২০২৩ এর প্রিলিমিনারি টেস্ট (MCQ Type) যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণপূর্বক আগামী ০৯ মার্চ ২০২৪ তারিখ, শনিবার সকাল...

বিসিএস পরীক্ষায় সাধারণ জ্ঞানে অসাধারণ হওয়ার কৌশল

বিসিএস পরীক্ষায় সাধারণ জ্ঞান কারও কাছে আগ্রহের বিষয়, কারও-বা ভয়ের কারণ। আগ্রহ বা ভয় যেটাই থাক না কেন...