‘বিসিএস ক্যাডার হওয়ার মতো কী যোগ্যতা তোমার আছে?’

Date:

Share post:

‘বিসিএস ক্যাডার হওয়ার মতো কী যোগ্যতা তোমার আছে?’

মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং থেকে পাস করে কী করব ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না। একবার ভেবেছিলাম, দেশের বাইরে চলে যাব। পরে এ চিন্তা বাদ দিয়ে সরকারি চাকরির জন্য প্রস্তুতি শুরু করি। প্রথমবারের মতো চাকরির ভাইভা দিই ৩৪তম বিসিএসে। প্রথমবার হওয়ায় মনে ভয় কাজ করছিল। কিন্তু বোর্ড চেয়ারম্যান এতটাই আন্তরিক ছিলেন যে মুহূর্তের মধ্যেই ভাইভা বোর্ডের পরিবেশটা স্বাভাবিক লাগতে শুরু করে। বিষয়ভিত্তিক প্রশ্নগুলোর খুব সহজেই উত্তর দিই। ‘কেন প্রথম পছন্দ পুলিশ ক্যাডার?’ এর উত্তরে বলেছিলাম পুলিশের শৃঙ্খলাবোধ, পদক্রম অনুযায়ী সম্মান প্রদর্শন ও ইউনিফর্ম আমার খুব ভালো লাগে। তা ছাড়া দেশ সেবার জন্য পুলিশ হতে পারে এক উত্তম পেশা।

কিন্তু তাঁরা আমার উত্তর কিছুতেই নিচ্ছিলেন না। পরিশেষে বলি—পুলিশে থেকে আমি জনগণের সংস্পর্শে যত সহজে আসতে পারব, অন্য পেশা থেকে ততটা সম্ভব নয়। আর জনগণের সংস্পর্শে থেকে জনগণের জন্য কিছু একটা করতে চাই। এবার তাঁরা উত্তর নিলেন। তবে খুব বেশি সন্তুষ্ট হতে পারেননি বুঝতে পারলাম। প্রথম দিকে ভালো করলেও শেষ দিকে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলি। এই বিসিএস থেকে ক্যাডারপ্রাপ্তির আশা ছিল না, পাইওনি।জীবনের দ্বিতীয় ভাইভা দিই এক্সপোর্ট ইমপোর্ট ব্যাংকে, ট্রেইনি অফিসার পদে। ভাইভা বোর্ডের একজন জিজ্ঞেস করেছিলেন ‘আপনি বিজ্ঞানের ছাত্র, আপনাকে আমরা ব্যাংকে কেন নেব?’ আমি বলেছিলাম, আমার পঠিত বিষয়ের সঙ্গে হয়তো ব্যাংক সেক্টরের সরাসরি সম্পর্ক নেই, তবে ব্যাংকে বিজ্ঞানের ছাত্র প্রয়োজন আছে। আর বিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে গণিতে আমি সব সময়ই ভালো। ‘গণিতে ভালো’ বলায় একটি সুদকষার অঙ্ক করতে বলা হয়। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই অঙ্কটি করে দেখাই। একজন ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফার ও শেয়ারবাজারের ওপর বেশ কয়েকটি প্রশ্ন করেছিলেন।

আমি ঝটপট উত্তর দিয়েছিলাম। ভাইভা বোর্ডের সবাই সন্তুষ্ট হয়েছিলেন। চলে আসার সময় আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন—চাকরিটা পেলে আমি করব কি না?পরে চাকরিটা পেলেও আর যোগ দেওয়া হয়নি।সহকারী থানা শিক্ষা অফিসার পদে দেওয়া ভাইভায় বোর্ডের একজন মেম্বার একটু রাগী প্রকৃতির ছিলেন। আমার রুমে প্রবেশ, চেয়ারে বসে থাকা থেকে শুরু করে প্রতিটি উচ্চারণের শুদ্ধি-অশুদ্ধি তিনি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছিলেন। আরেকজন মেম্বার জানতে চান—সহকারী থানা শিক্ষা অফিসার হিসেবে নিয়োগ পেলে আমার কাজ কী হবে? সততার সঙ্গে কাজ করতে গেলে কী কী বাধা আসবে, স্কুল পরিদর্শনে গিয়ে কী কী বিষয় দেখব।

বেশ ভালোভাবেই প্রশ্নটার উত্তর দিই। কিন্তু বিপত্তি বাধে ‘শিক্ষক’ না বলে ভুলে এর ইংরেজি শব্দ ‘টিচার’ বলে ফেলায়। কেন বাংলা না বলে ইংরেজিতে টিচার বললাম, বাংলার সঙ্গে কেন ইংরেজি মেশালাম—এটা নিয়ে তাঁরা অনেকক্ষণ পেঁচিয়েছেন। ভাইভা শেষে বের হওয়ার সময় বোর্ড চেয়ারম্যান আবারও ডাক দিলেন। আমার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, দেশের কোন জেলায় শিক্ষার হার সবচেয়ে বেশি বলতে পারবা? জানা এ প্রশ্নটি কিছুতেই মাথায় আসছিল না। একবার ভুল বলায় তাঁরা পরস্পরের দিকে তাকিয়ে হাসছিলেন। বাংলাদেশে কতগুলো সরকারি প্রাইমারি স্কুল আছে, বলতে পারবা? পড়ে আসা জিনিসগুলো মাথায় ছিল, কিন্তু মুখে আসছিল না। আমি প্রাইমারি স্কুল বলার পরিবর্তে বলে ফেলি প্রাথমিক স্কুল।

এবার আর তাঁরা হাসি কোনোভাবেই চেপে রাখতে পারেননি। তিক্ত এ ভাইভার কথা মনে হলে আজও আমার হাসি পায়।সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে ভাইভা দিই ৩৬তম বিসিএসে। ভাইভা বোর্ডে ঢুকে অনুমতি নিয়ে চেয়ারে বসতে যাব—ঠিক তখনই বোর্ড চেয়ারম্যান বললেন, তুমি দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবসের ওপর তিন মিনিট বক্তৃতা দাও। বক্তৃতা শেষে বসতে বলার পর একের পর এক প্রশ্ন করা শুরু করলেন। সবচেয়ে বেশি প্রশ্ন করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে। একজন এক্সটার্নাল কয়েকটা বাংলা ও ইংরেজি বানান লিখতে দিয়েছিলেন।

সব বানানই শুদ্ধ লিখেছিলাম। তা ছাড়া সংবিধান, পঠিত বিষয়, মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত সব প্রশ্নেরই সাবলীল উত্তর প্রদান করেছিলাম। ভাইভা বেশ ভালো হলেও এই বিসিএসে ক্যাডার পাওয়া হয়ে ওঠেনি।সর্বশেষ ভাইভা দিই ৩৭তম বিসিএসে। রুমে ঢুকে চেয়ারে বসতে না বসতেই বোর্ড চেয়ারম্যান আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, দুই আর দুইয়ে চার হয়, দুই আর দুইয়ে আর কত হয়? খানিকটা ভেবে বললাম ২২ হয় স্যার। উত্তর শুনে তিনি মুচকি হাসছিলেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, পুলিশে আসতে চাচ্ছ? এটা তো অনেক চ্যালেঞ্জিং পেশা। গুলি করতে পারবে মানুষের বুকে? আমি উত্তর দিলাম—দেশ, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য আমি আমার প্রাণ উত্সর্গ করতে রাজি আছি স্যার। উত্তর শোনার পর তাঁরা তিনজনই কিচ্ছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন।

ভাইভার একেবারে শেষের দিকে এক্সটার্নাল স্যার আমাকে বললেন, তোমাকে লাস্ট একটা প্রশ্ন করব, বুঝে-শুনে উত্তর দেবে। বিসিএস ক্যাডার হওয়ার মতো কী যোগ্যতা তোমার আছে, আমরা তোমাকে কেন নেব? একটু ভেবে বললাম, স্যার বিজ্ঞাপনে উল্লিখিত শর্ত পূরণ করে প্রিলি ও লিখিত পাস করে ভাইভার জন্য আমি আপনাদের সামনে। আর আমি মনে করি, দেশের স্বার্থে আমাকে আপনারা যেভাবে গড়ে তুলতে চাইবেন ঠিক সেভাবেই গড়ে তুলতে পারবেন। আমি আরো মনে করি, এটাই আমার সবচেয়ে বড় যোগ্যতা। তাঁরা আমাকে শুভকামনা জানিয়ে আসতে বললেন।

এ ভাইভায় প্রায় সব প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে পেরেছিলাম। ফল প্রকাশের পর দেখি, আমি পুলিশ ক্যাডারে অষ্টম হয়েছি।ভাইভা নিয়ে অনেকের মধ্যেই একটা ভীতি কাজ করে। তবে নিয়মমাফিক প্রস্তুতি নিতে থাকলে এ ভীতি অনেকাংশেই কেটে যাবে। নিজের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস আর বিনয়ের সঙ্গে ভাইভা বোর্ডকে কনভিন্স করতে পারলে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য অর্জন করা সম্ভব হবে।

*BCS Viva দিতে গিয়ে অনেকেরই হয় নানা অম্লমধুর অভিজ্ঞতা। এম এম মুজাহিদ উদ্দীনকে ভাইভা বোর্ডের মুখোমুখি হওয়ার বিসিএস ভাইভা অভিজ্ঞতার গল্প শুনিয়েছেন ৩৭তম বিসিএস পুলিশ ক্যাডারে অষ্টম স্থান অধিকারী মো. দিদারুল ইসলাম*

সূত্রঃ কালের কন্ঠ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_img

Related articles

Prepositional Phrase কাকে বলে? চেনার উপায়।

যে Phrase বা শব্দ সমষ্টি Preposition এর কাজ করে তাকে Prepositional Phrase বলে। Preposition মূলত: Noun / Noun equivalent...

Gerund কাকে বলে? চেনার উপায় এবং এর ব্যবহার।

বাক্যে যে Verb এর শেষে ing যুক্ত হয়ে যে Verb একই সাথে Verb ও Noun-এর কাজ করে থাকে...

৪৬তম বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষা ০৯ মার্চ

8৬তম বি.সি.এস পরীক্ষা-২০২৩ এর প্রিলিমিনারি টেস্ট (MCQ Type) যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণপূর্বক আগামী ০৯ মার্চ ২০২৪ তারিখ, শনিবার সকাল...

বিসিএস পরীক্ষায় সাধারণ জ্ঞানে অসাধারণ হওয়ার কৌশল

বিসিএস পরীক্ষায় সাধারণ জ্ঞান কারও কাছে আগ্রহের বিষয়, কারও-বা ভয়ের কারণ। আগ্রহ বা ভয় যেটাই থাক না কেন...