উনিশ শতকের শুরুতে বাংলা ভাষার গদ্যরূপ প্রকাশিত হয়। আরো পরে বাংলা কথাসাহিত্য তথা উপন্যাস শিল্পের বিকাশ। রাজা রামমোহন রায়, বিদ্যাসাগর সহ খ্যাতিমান লেখকদের সংস্কৃত ও ইংরেজি ভাষার উচ্চমার্গের সাধু ভঙ্গিতে লেখা গ্রন্থ যখন সাধারণ মানুষের পক্ষে অসম্ভব ছিল প্যারীচাঁদ মিত্র তখন লেখক্য ও কথ্যরীতির মিলন ঘটিয়ে সাধারণ মানুষের মুখের ভাষা অবলম্বনে সর্বজনবোধগম্য নবতর এক গদ্য রীতির সূচনা করেন।
আর এ রীতি অবলম্বন করে বাংলা উপন্যাসের প্রাথমিক প্রচেষ্টা হিসেবে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের উল্লেখযোগ্য প্যারীচাঁদ মিত্রের “আলালের ঘরের দুলাল” (১৮৫৮)। সংস্কৃত এবং ইংরেজ লেখকদের অনুসরণ সেকালের কলকাতার অঞ্চলের সাধারণ মানুষের মুখের ভাষাকে সাহিত্যের বাহন হিসেবে গ্রহণ করে নিজস্ব চিন্তা চেতনার আলোকে বিষয়বস্তু নির্বাচনের মাধ্যমে রচনা করেন ‘আলালের ঘরের দুলাল’।
আলালের ঘরের দুলাল প্যারীচাঁদ মিত্রের প্রথম গ্রন্থ। ১৮৫৪ সাল থেকে একটি পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় ১৮৫৮ সালে। সাহিত্য সমালোচকদের মতে, এটি বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সামাজিক নকশা। গ্রন্থটি সম্পন্ন সামাজিক পটভূমিকায় রচিত। নব্য শিক্ষিত বাঙালি যুবকদের কার্যকলাপ ও পরিণতি গ্রন্থের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়।
এখানে দেশীয় শিক্ষা ব্যবস্থা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিশৃঙ্খলা ও পাশ্চাত্য সভ্যতার অন্ধ অনুকরণ নিয়ে লেখক এর অভিমত প্রকাশ করেছেন। তবে আধুনিক ইংরেজি শিক্ষার আলোকে উচ্চ আদর্শ জীবন গঠনকে লেখক স্বাগত জানিয়েছেন। প্যারীচাঁদ মিত্র এই নবলব্ধ দৃষ্টিকোণ থেকে লক্ষ্য করেছেন যে ধর্ম ও নীতিহীনতা উচ্ছৃংখলতার মূল কারণ। সুতরাং ধর্মীয় ও নৈতিক জীবনযাত্রা প্রণালীর মধ্যেই রয়েছে এ থেকে মুক্তির পথ। একথা প্রমান করার জন্য তিনি লিখেছেন “আলালের ঘরের দুলাল”।
আলালের ঘরের দুলালের কাহিনী এরূপ- ধনী বিষয়ী বাবুরামের অতি আদরের পুত্র মতিলাল আবাল্য কখনও ধর্মীয় ও নীতির শিক্ষা পায় নি। শিক্ষার ব্যাপারেও পিতা ছিলেন উদাসীন । উপরন্ত কুসঙ্গ তাকে অধঃপতনের শেষ ধাপে
নিয়ে যায়। পিতার মৃত্যুর পর প্রাপ্ত সব সম্পত্তি নষ্ট করে ফেলে । পরে দুঃখের জীবনে তার বোধদয় ঘটে এবং হৃদয়-মন পরিবর্তিত হয়। অন্যদিকে মতিলালের অনুজ রামলাল আদর্শ চরিত্র । বরদাবাবুর একান্ত সেহ্নছায়ায় বড় হয়ে নির্দেশ মান্য করে সে সর্বজনের প্রশংসা অর্জন করেছে। মতিলালের চৈতন্যবোধ এবং আদর্শ জীবনের প্রতি আকর্ষণের মাধ্যমে সমাপ্তি ঘটে উপন্যাসের।
গ্রন্থের এই দুই প্রধান ঘটনাস্রোত বিচিত্র খন্ড ক্ষুদ্র ঘটনায় পল্লবিত হয়েছে। মূল ঘটনা অপেক্ষা এ বিচিত্র ক্ষুদ্র পল্লবিত ঘটনাই গ্রন্থটির আশ্চর্য সফলতার কারণ। বস্তত: বরদাবাবুর মত মূর্তিমান নীতিপাঠ, বেনী বাবুর মত সজ্জন অথবা আদর্শ যুবক রামলাল এরা কেউই আলালের মত মূল আকর্ষণীয় নয়। এদের মধ্যে সুশিক্ষা থাকতে পারে কিন্তু উপন্যাসের যা প্রধানতম উপকরণ জীবনের স্বাদ তা এই চরিত্রগুলোতে নেই। আলালের অবিস্মরণীয় সাফল্য এনে দিয়েছে মতিলাল স্বয়ং এবং তার সাঙ্গপাঙ্গ হলধর, গদাধর ইত্যাদি। এছাড়াও ধূর্ত উকিল বটলর, ধরিবাজ মুৎসদ্দি বাঞ্চারাম, তোষামোদকারী বক্রেশ্বর বাবু ইত্যাদি চরিত্র জীবন্ত।
তবে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য হলো মোকাজান মিঞা বা ঠকচাচা। চরিত্রটি ধূর্ততা, বৈষয়িক বুদ্ধি ও প্রাণময়তা নিয়ে এ গ্রন্থের সবচেয়ে জীবন্ত চরিত্র। আলালের ঘরের দুলাল উপন্যাসের কাহিনী নির্মাণে ক্রটি থাকা সত্ত্বেও সমাজের খন্ডচিত্রগুলো সুনিপুনভাবে অঙ্কিত হয়েছে। যা সহজেই পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে । এ গ্রন্থে তিনি প্রথমবারের মত বাংলা সাহিত্যের গদ্যরীতির নিয়ম ভেংগে সচেতনভাবে সংস্কৃতের পরিবর্তে চলতি ভাষা প্রয়োগ করেছেন। যা সাধারণ মানুষের ভাষা। এ উদ্যোগটি বিশেষভাবে স্মরণীয়। এ গদ্যরীতি বাংলা সাহিত্যে “আলালী রীতি’ হিসেবে পরিচিত । আর এর মধ্য দিয়ে বাংলা সাহিত্যে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র শিল্পনৈপূন্য প্রদর্শনপূর্বক তিনি হয়ে উঠলেন প্রথম সার্থক গদ্যশিল্পী এবং স্বকীয় সত্তায় ভাস্বর । আলালের ঘরের দুলাল উপন্যাস হিসেবে স্বার্থক না হতে পারে কিন্ত এ গ্রন্থের মাধ্যমে বাংলা গদ্য সাহিত্যে এক নতুন পথ সূচিত হয়েছে এবং আধুনিক উপন্যাস রচনার পথ সুগম করে দিয়েছে।
আলালী ভাষারীতি বাংলা গদ্যের মাধ্যম হিসেবে টিকতে পারেনি । কিন্তু পরবর্তীকালে বঙ্কিমচন্দ্রের হাতে যে আদর্শ গদ্যরীতির উদ্ভব ঘটেছিল তার পিছনে এ আলালী রীতির অবদান অনস্বীকার্য। আর এখানেই প্যারীচাঁদ মিত্রের সার্থকতা । প্যারীটাদ মিত্র “টেকটাদ ঠাকুর ছদ্মনামে এ উপন্যাসটি পত্রিকায় লেখেন। আলালের ঘরের দুলাল উপন্যাস কিনা এ নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। কেউ বলেন এটি বাংলা ভাষার প্রথম উপন্যাস। আবার কারো মতে এটি উপন্যাস নয়, উপন্যাসের লক্ষণাক্রান্ত। আলালের ঘরের দুলাল সার্থক উপন্যাস না হলেও বাংলা ভাষায় উপন্যাস রচনার প্লাটফর্মটি তৈরি করে দেয়। এ গ্রন্থটি ‘দি স্পয়েড চাইন্ড’ নামে ইংরেজীতেও অনুদিত হয়েছে।