প্রিয় পাঠকবৃন্দ আজকে আমরা বিসিএস সহ অন্যান্য পরীক্ষার আগত গুরুত্বপূর্ণ পৃথিবীর বিখ্যাত ৪টি প্রণালী নিয়ে আলোচনা করব। যে প্রণালীগুলো এক মহাদেশ থেকে আরেক মহাদেশকে বিভক্ত করেছে। নিচে সে সকল প্রণালীর বিস্তারিত আলোচনা করা হলো:
বসফরাস প্রণালী: বসফরাস প্রণালী এশিয়া থেকে ইউরোপকে পৃথক করেছে। বসফরাস একটি জলপ্রণালী যা এশিয়া ও ইউরোপের মধ্যবর্তি অঞ্চলের একটি অংশে সীমানা নির্দেশ করে। এটিকে অনেক সময় ইস্তানবুল প্রণালীও বলা হয়। বসফরাস, মারমারা উপসাগর এবং দক্ষিণ পশ্চিমের দার্দেনেলাস প্রণালী মিলে তুর্কি প্রণালী গঠিত। বসফরাস প্রণালী বিশ্বের নৌ চলাচলে ব্যবহৃত সবচেয়ে সরু জলপথ। বসফরাস প্রণালী কৃষ্ণ সাগরকে মারমারা উপসাগরের সাথে যুক্ত করেছে। বসফরাস প্রণালীর দুপাশে দু’টি করে চারটি বাতঘর দ্বারা এর সীমানা চিহ্নিত করা হয়েছে। এই সীমানার মধ্যে বসফরাস প্রণালীর দৈর্ঘ্য ৩১ কিলোমিটার। উত্তরের অংশে এর প্রস্থ ৩৩২৯ মিটার এবং দক্ষিণের অংশে প্রস্থ ২৮২৬ মিটার। বসফরাসের সর্বোচ্চ প্রস্থ ৩৪২০ মিটার এবং সর্বনিম্ন প্রস্থ ৭০০ মিটার। সর্বনিম্ন প্রস্থের অংশে নৌ ও ফেরি চলাচল খুবই বিপজ্জনক। কারণ এখানে জলযানের দিক বাক নেয়ার সময় বিপরীত দিক থেকে আগত জলযান দেখা যায় না। এ সমস্যাটি এখানে আরও বেশি প্রকট কারণ বসফরাস দিয়ে প্রচুর জলযান যাতায়াত করে।
বসফরাসের গভীরতা ১৩ থেকে ১১০ মিটারের মধ্যে পরিবর্তিত হয়। এর গড় গভীরতা ৬৫ মিটার। গোল্ডেন হর্ন বসফরাস প্রণালীর একটি মোহনা। এটি অতীতে ইস্তানবুলের পুরোনো অংশকে আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা করতে দুর্গপরিখা হিসেবে কাজ করতো। এছাড়া এখানে উসমানীয় সাম্রাজ্যের নৌবাহিনীর জলযান নোঙ্গর বাঁধার স্থান হিসেবে ব্যবহৃত হত। বসফরাস নামটি গ্রীক Bosporos থেকে এসেছে। বিংশ শতকের পূর্ব থেকেই এটি মানুষের জানা ছিল যে, কৃষ্ণ সাগর এবং মারমারা উপসাগর পরস্পর একটি গভীর পানিপথ দ্বারা যুক্ত। এই পানিপথটি ভূপৃষ্ঠের থেকে দৃশ্যমান জলের নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। ২০১০ এর আগস্টে জানা যায় যে পানির নিচ দিয়ে প্রবাহিত এই চ্যানেলটি বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম নদী হতে পারতো যদি এটি ভূমির উপর দিয়ে প্রবাহিত হত। বসফরাসের তীরবর্তি কিছু অংশে কংক্রীট দিয়ে শক্ত করা হয়েছে এবং যে সমস্ত জায়গায় মাটির অবক্ষেপ পড়ে, সেখানে নিয়মিত ড্রেজিং করা হয়।
বাব এল মান্দেব প্রণালী: বাব এল মান্দেব প্রণালী এশিয়া থেকে আফ্রিকাকে পৃথক করেছে। লোহিত সাগর ও এডেন উপসাগরকে যুক্ত করেছে।বাব এল মান্দেব লোহিত সাগর ও এডেন উপসাগরকে সংযোগকারী একটি প্রণালী। প্রণালীটি আরব উপদ্বীপে অবস্থিত ইয়েমেন এবং হর্ন অব আফ্রিকায় অবস্থিত জিবুতি, ইরিত্রিয়া ও সোমালিয়াকে পৃথক করেছে। আরবী বাব এল মান্দেবের অর্থ দুর্দশার দুয়ার। ইংরেজিতে প্রণালীটিকে কখনও কখনও মান্দাব প্রণালী হিসেবে অভিহিত করা হয়। বাব এল মান্দেব নামটি সম্ভবত উদ্ভূত হয়েছে প্রণালীটিতে দিকনির্দেশনায় সমস্যার কারণে। আবার আরব কিংবদন্তী অনুসারে, এক প্রলয়ঙ্করী ভূমিকম্পে এশিয়া আর আফ্রিকা আলাদা হয়ে যায় এবং তার ফলে প্রচুর মানুষ মৃত্যুবরণ করে। সেই দুর্যোগের কথা স্মরণ করে প্রণালীটির নাম রাখা হয়েছে বাব এল মান্দেব বা দুর্দশার দুয়ার। বাব এল মান্দেব লোহিত সাগর ও সুয়েজ খাল হয়ে ভারত মহাসাগর ও ভূমধ্যসাগরের মধ্যে একটি কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ হিসেবে কাজ করে। ২০০৬ সালে এ প্রণালীটি দিয়ে প্রতিদিন গড়ে ৩.৩ মিলিয়ন ব্যারেল তেল বহন করা হয় যেখানে সমগ্র বিশ্বে তেলবহনকারী ট্যাঙ্কারের মাধ্যমে বহন করা হয় গড়ে ৪৩ মিলিয়ন ব্যারেল তেল। ২০০৮ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি জানা যায় যে, তারেক বিন লাদেন মালিকানাধীন কোম্পানী বাব এল মান্দেবের দুই প্রান্ত, ইয়েমেন ও জিবুতিকে সংযোগকারী একটি সেতু নির্মানের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। বাব এল মান্দেব আরব লীগের একটি উপঅঞ্চল হিসেবে বিবেচিত। এর সদস্যগুলো হল: ইয়েমেন, সোমালিয়া, জিবুতি ও কোমোরোস দ্বীপপুঞ্জ।
জিব্রাল্টার প্রণালী: জিব্রাল্টার প্রণালী ইউরোপ থেকে আফ্রিকাকে পৃথক করেছে। ভূমধ্যসাগর ও আটলান্টিক মহাসাগরকে সংযোজনকারী একমাত্র প্রাকৃতিক পথ। জিব্রাল্টার প্রণালী পূর্বে ভূমধ্যসাগরকে পশ্চিমে আটলান্টিক মহাসাগরের সাথে সংযোগকারী সমুদ্র প্রণালী। এটি উত্তর আফ্রিকাকে দক্ষিণ-পশ্চিম ইউরোপের আইবেরীয় উপদ্বীপ থেকে পৃথক করেছে। প্রণালীটি ৬০ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং এর প্রস্থ অবস্থানভেদে ১৩ থেকে ৩৯ কিলোমিটার হতে পারে। প্রণালীর মধ্য দিয়ে একটি ৮ কিলোমিটার প্রশস্ত ও ৩০০ মিটার গভীর চ্যানেল চলে গেছে। জিব্রাল্টার প্রণালী দিয়ে অনবরত আটলান্টিক মহাসাগর থেকে পানি ভূমধ্যসাগরে প্রবেশ করছে এবং পশ্চিমমুখী একটি অন্তঃপ্রবাহ ভূমধ্যসাগরের লবনাক্ত পানি আটলান্টিক মহাসাগরে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। জিব্রাল্টার প্রণালীর পূর্ব প্রান্তে “হার্কিউলিসের স্তম্ভসমূহ” নামের একজোড়া শৈলান্তরীপ রয়েছে। উত্তরেরটি জিব্রাল্টারের শিলা এবং দক্ষিণেরটি জাবাল মুসা নামে পরিচিত।
বেরিং প্রণালী: বেরিং প্রণালী এশিয়া থেকে আমেরিকাকে পৃথক করেছে। উত্তর মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরকে যুক্ত করেছে; আলাস্কা ও সাইবেরিয়াকে পৃথক করেছে। বেরিং প্রণালী এশিয়া ও উত্তর আমেরিকা মহাদেশ দুইটিকে পৃথককারী জলাশয়। প্রণালীটি উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরের বেরিং সাগরকে উত্তর মহাসাগরের চুক্চি সাগরের সঙ্গে যুক্ত করেছে।
১৬৪৮ সালে রুশ অভিযানকারী সেমিয়োন ইভানোভিচ দেজনিয়ভ বেরিং প্রণালী আবিষ্কার করেন। পরবর্তীতে ১৭২৮ সালে ডেনীয় নাবিক ভিতুস বেরিং এবং তারও পরে ব্রিটিশ নাবিক ক্যাপ্টেন জেমস কুক ও ফ্রেডেরিক উইলিয়াম বিচি এখানে আসেন।
প্রণালীটির সবচেয়ে সরু অংশ রাশিয়ার দেজনিয়ভ অন্তরীপ এবং আলাস্কার প্রিন্স অফ ওয়েল্স অন্তরীপের মধ্যে অবস্থিত। এই দুই অন্তরীপের মধ্যবর্তী সর্বনিম্ন দূরত্ব ৮৫ কিলোমিটার। দুই অন্তরীপের মধ্যস্থলে ডায়োমিড দ্বীপপুঞ্জ অবস্থিত। প্রণালীটির গভীরতা ৩০-৫০ মিটার। ১৬৫৪ সালে রুশ বণিক ফেদত আলেক্সেইয়েভ সাইবেরিয়ার কোলিমা উপদ্বীপের পূর্বে পোগিচা নদীর সন্ধানে রওনা দেন। এই ভ্রমণে তার সহযোগী ছিলেন সেমিয়োন ইভানোভিচ দেজনিয়ভ। দেজনিয়ভই এই অভিযানে প্রথম ব্যক্তি হিসেবে উত্তর মহাসাগর থেকে প্রশান্ত মহাসাগরে নৌপথে প্রবেশ করেন। কিন্তু তার এই আবিষ্কারের কাহিনী রুশ কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে তখন পৌঁছেনি। রুশ সম্রাট মহান পিটার তাই জানতেন না সাইবেরিয়া উত্তর আমেরিকার সাথে যুক্ত কি না। পিটার তার মৃত্যুর কিছুদিন আগে রুশ সামরিক বাহিনীর একজন কমাণ্ডার ডেনীয় বংশোদ্ভুত ভিতুস বেরিং-কে এটা খুঁজে দেখার আদেশ দেন। বেরিং নৌপথে বেরিয়ে পড়েন এবং ১৭২৮ সালে বেরিং প্রণালী পুনরাবিষ্কার করেন, কিন্তু ভারী কুয়াশার কারণে তিনি সেবার উত্তর আমেরিকার স্থলভাগ দেখতে পাননি।
এরপর ১৭৪১ সালের জুন মাসে বেরিং আবার সদলবলে অভিযানে বের হন এবং এবার তিনি আলাস্কার স্থলভাগ দেখতে পান। ১৬ই জুন, সাধু এলিয়াসের দিবসে, দূর থেকে দেখে তিনি আলাস্কার সেন্ট এলিয়াস পর্বতের নামকরণ করেন। ঐ অভিযানেই ফেরার পথে বেরিং জাহাজ ভেঙে একটি দ্বীপে (যার বর্তমান নাম বেরিং দ্বীপ) আটকা পড়েন এবং সেখানেই শীতকালে মারা যান। বেরিং-এর এই অভিযানের ফলে উত্তর-পশ্চিম আমেরিকা (বর্তমান আলাস্কা) রাশিয়ার দখলে আসে।