কিভাবে এলো বাংলা ভাষা ( বাংলা ভাষার ইতিপূর্ব) পর্ব -১

Date:

Share post:

কিভাবে এলো বাংলা ভাষা ( বাংলা ভাষার ইতিপূর্ব)

প্রাকৃত ভাষা

প্রাচীন ভারতবর্ষে সর্বসাধারণের কথ্যভাষা ছিল প্রাকৃত ভাষা। খ্রিষ্টপূর্ব ৪৫০ অব্দ থেকে ১০০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত একাধারে লিখিত ও কথ্য ভাষারূপে ভারতের নানা জায়গায় এ প্রাকৃত ভাষাসমূহ প্রচলিত ছিল। সাধারণ মানুষের কথ্যভাষা প্রাকৃত থেকেই বাংলা ভাষার উৎপত্তি। ধারণা করা হয় প্রাচীন ভারতের প্রাকৃত ভাষাগুলোর মধ্যে পালি অন্যতম, যার জন্ম খ্রিষ্টজন্মেরও কমপক্ষে ছ শ বছর আগে। পালি ছিল মধ্য বিহারের মগধ অধিবাসীদের মুখের ভাষা।

পালি মুখ্যত কথ্য ভাষা হলেও তার সুনির্দিষ্ট ব্যাকরণ ছিল এবং তাতে কাব্য, নাটক ইত্যাদি রচিত হয়েছিল। যুগ যুগ ধরে ভারতে (মূল অংশে) যেমন সংস্কৃতের কদর বা ইউরোপে ল্যাটিনের—গঙ্গার এপারে বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে পালিও ঠিক তা-ই আছে এখন পর্যন্ত, যেমনটি শত বছর ধরে ছিল। কিন্তু এত যে পুরোনো ভাষা, এত সুদূরব্যাপী যার বিস্তার, এবং এত সব মূল্যবান ঐতিহাসিক নিদর্শন যার রয়েছে সেই পালি তার যথাযথ মর্যাদা পায়নি। তার সম্মানে কোনো রচনা প্রকাশিত হয় না।

এমনকি গবেষক ও ভাষাতাত্ত্বিকদের নিকটও পালি যেন অনেকটাই অপরিচিত। এই অসম্মান ও অনাদর পালির পাওনা ছিল না। সংস্কৃতের মতোই পালিরও মৃত্যু ঘটেছে বহু শতাব্দীকাল আগেই। অর্থাৎ এখন আর এ ভাষার কোনো স্থানীয় জাতি নেই, বা সে অর্থে মাতৃভাষা হিসেবে ব্যবহারের মানুষ নেই; কেবল সাহিত্যিক ও ধর্মীয় ভাষা হিসেবেই ব্যবহৃত হয়। গৌতম বুদ্ধ এ ভাষাতেই ধর্ম প্রচার করেছিলেন। মূলত একটি সাধারণ প্রাদেশিক ভাষা হয়েও এটি ক্রমান্বয়ে শক্তিশালী ভাষা হয়ে উঠেছিল, যা তাকে বসিয়েছে চিরায়ত ভাষার আসনে। সংস্কৃতের সাথে এর সম্পর্ক অনেকটা বোনের মতো।

পালি এবং সংস্কৃত, যদিও নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে দুজনের মধ্যে, ছিল হারানো আর্যভাষার সম্পূর্ণ পৃথক ও স্বাধীন দুটি ভাষা-শাখা। এই অর্থে হারানো আর্যভাষাই এই সহদোরা র প্রকৃত মা। হারানো আর্যভাষা মূলত ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাবংশেরই সদস্য। ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাবংশ বলতে মূল ভাষাগোষ্ঠীকে বোঝায়। যেসব ভাষা ইউরোপের অনেকটা অংশজুড়ে এবং বৃহত্তর দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথমে বিস্তৃতি লাভ করে তাদের সম্মিলিতভাবে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা-পরিবার বলা হয়।

অবশ্য এসব ভাষাভাষী গোষ্ঠী বর্তমানে সারা পৃথিবীজুড়েই ছড়িয়ে পড়েছে। পৃথিবীর অর্ধেকের চেয়েও বেশি মানুষ এ পরিবারভুক্ত ভাষায় কথা বলে থাকেন। আমাদের মাতৃভাষা বাংলাসহ গ্রিক, ল্যাটিন, ইংরেজি, হিন্দি, ফারসি, ফরাসি, ডাচ, নেপালি ইত্যাদি ভাষা ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা-পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। আনুমানিক পাঁচ হাজার বছর পূর্বে এই মূল ভাষার অস্তিত্ব ছিল।

এই ভাষা-পরিবারের ভাষা-শাখাগুলোর মধ্যকার পার্থক্যগুলো সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে আজ থেকে তিন বা চার হাজার বছর আগে। মূলত ওই সময়ের মধ্যেই গ্রিক, অ্যান্টোলিন এবং ইন্দো-ইরানীয় প্রভৃতি ভাষা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিল। বলা হয়ে থাকে এসব ভাষা এসেছে পূর্ব ইউরোপ এবং পশ্চিম এশীয় অঞ্চলের সমভূমিতে ঘুরে বেড়ানো যাযাবর উপজাতির কাছ থেকে। এ অঞ্চলকে একসময় ‘গোবি’ও বলা হতো।

এটি খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০০ সালের কথা। খ্রিষ্টপূর্ব ২০০০ সাল থেকে ইন্দো-ইউরোপীয় পরিবারের ভাষাভাষী লোকেরা ইউরোপ ছাড়িয়ে আটলান্টিকের উপকূল এবং ভূমধ্যসাগরের উত্তর কূলের দিকে আসতে শুরু করে। পারস্য ও ভারত জয়ের মধ্য দিয়ে তারা ছড়িয়ে যায় এশিয়ার দূর এলাকাসমূহে। সমসাময়িক সময়েই সিন্ধুর অধিবাসীগণও পূর্বদিকে (গাঙ্গেয় সমভূমি) এবং পশ্চিম এবং আফগানিস্তান) ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। খ্রিষ্টপূর্ব ১০০০ অব্দের মধ্যে দুটি ভাষা-শাখা, ভারতীয় আর্যভাষা (ইন্দো-আর্য) এবং ইন্দো-ইরানীয় ভাষা, আলাদা হয়ে যায়। ভারতীয় আর্যভাষার ইতিহাসে তিনটি প্রধান স্তর লক্ষ করা যায়।

১. প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষা—বৈদিক এবং সংস্কৃত ভাষার স্তর : সংস্কৃতের প্রাচীন রূপই হচ্ছে বৈদিক ভাষা, যা প্রচলিত ছিল আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ১৫০০ অব্দ থেকে খ্রিষ্টপূর্ব ৫০০ অব্দ পর্যন্ত। বৈদিক ভাষায় প্রথম ইন্দো-ইউরোপীয় কাব্য/ধর্মগ্রন্থ বেদ রচিত হয়েছিল। এ ভাষাটি যখন সাধারণ মানুষের কাছে দুর্বোধ্য হয়ে ওঠে তখন ব্যাকরণবিদগণ নানা নিয়ম বিধিবদ্ধ করে একটি মানসম্পন্ন ভাষা সৃষ্টি করেন, যার নাম সংস্কৃত। খ্রিষ্টপূর্ব ৪০০ অব্দের দিকে এ ভাষাটি চূড়ান্তভাবে বিধিবদ্ধ হয় ব্যাকরণবিদ পাণিনির হাতে। মূলত সংস্কৃত ছিল সাহিত্য এবং প্রায়োগিক কৌশলসংক্রান্ত কাজের ভাষা।

প্রাকৃত ভাষার যুগেও (যার শুরু আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ৬০০ অব্দ থেকে) সাহিত্যের ভাষা ও শিক্ষিত জনের ভাবপ্রকাশের মাধ্যম হিসেবে এর ব্যবহার ছিল। শিক্ষিত লোকজন সংস্কৃত ও প্রাকৃত এই উভয় ভাষাই জানতেন এবং প্রয়োজনে যে কোনো একটি ভাষা ব্যবহার করতেন। অনেকটা আমরা যেমন ‘মান বাংলা’ আর ‘আঞ্চলিক বাংলা’ এই দুই ভাষাই ব্যবহার করে থাকি বা করতে পারি তেমন। খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় শতকে রচিত কালিদাসের কাব্য ও নাটকের ভাষা ছিল সংস্কৃত। রামায়ণ ও মহাভারত সংস্কৃত ভাষাতেই রচিত হয়েছে। এমনকি এত কাল পরেও সংস্কৃত ভারতে ব্যাপকভাবে পঠিত/চর্চিত এবং একটি পবিত্র ভাষা হিসেবে স্বীকৃত।

২. মধ্য ভারতীয় আর্যভাষা—পালিসহ অন্যান্য প্রাকৃত ভাষার স্তর (অপভ্রংশ) : ধারণা করা হয় এই স্তরের সূচনাকাল খ্রিষ্টপূর্ব আনুমানিক ৬০০ অব্দ। জৈন ধর্মের অনেক গ্রন্থ ও বৌদ্ধ ধর্মের প্রধান ধর্মগ্রন্থ ত্রিপিটক প্রাকৃত পালি ভাষায় লেখা। মনে করা হয়, খ্রিষ্টপূর্ব ৫৩৭ অব্দে বোধি লাভ করে সিদ্ধার্থ গৌতম ‘বুদ্ধ’ নামে পরিচিত হন। একই সময় চতুর্বিংশতিতম জৈন তীর্থঙ্কর মহাবীর একই ধরনের অপর একটি ধর্মতত্ত্ব প্রচার করেন; পরবর্তীকালে যা জৈনধর্ম নামে পরিচিত হয়। বুদ্ধের শিক্ষা ও জৈন ধর্মতত্ত্ব নির্বাণতত্ত্বের কথা বলে। প্রাকৃত ভাষায় রচিত হওয়ায় তাঁদের ধর্মমত সহজেই সর্বজনগ্রাহ্য হয়ে উঠতে সক্ষম হয়। সংস্কৃত ব্যাকরণবিদ পতঞ্জলির মহাভাষ্য গ্রন্থে সর্বপ্রথম “অপভ্রংশ” শব্দটির উল্লেখ পাওয়া যায়।

তিনি সংস্কৃত থেকে উদ্ভূত কিছু অশিষ্ট শব্দকে নির্দেশ করার জন্য শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। বর্তমান ভাষাবিদদের মতে সমস্ত প্রাকৃত ভাষারই শেষ স্তরটি হল অপভ্রংশ এবং এই অপভ্রংশগুলি থেকেই সমস্ত নব্য ইন্দো-আর্য ভাষা উদ্ভূত হয়েছিল। উদাহরণস্বরূপ, পূর্ব ভারতে প্রচলিত মাগধী প্রাকৃত ভাষা থেকে পূর্বী অপভ্রংশ উদ্ভূত হয়েছিল এবং সেই পূর্বী অপভ্রংশ থেকে মগহী, মৈথিলী ও ভোজপুরী—এই তিনটি বিহারী ভাষা এবং বাংলা, অসমীয়া ও ওড়িয়া—এই তিনটি গৌড়ীয় ভাষার উৎপত্তিলাভ ঘটে। অন্যদিকে, পশ্চিমের শৌরসেনী অপভ্রংশ থেকে হিন্দি ও অন্যান্য নব্য ইন্দো-আর্য ভাষার উদ্ভব হয়।

অপভ্রংশ খ্রিষ্টীয় দ্বাদশ শতক পর্যন্ত প্রচলিত ছিল, যদিও খ্রিষ্টীয় দশম শতক থেকেই আধুনিক আর্যভাষাগুলো বিকশিত হতে শুরু করেছিল। ভাষার সংখ্যা অননুমেয় হলেও হিন্দি, উর্দু, বাংলা, বিহারি, গুজরাতি, কানাড়া, মালয়ালাম, মারাঠি, ওড়িয়া, পাঞ্জাবি, রাজস্থানি, তামিল, এবং তেলেগুর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এসব ভাষার প্রত্যেকটিতেই বর্তমানে এক কোটিরও বেশি লোক কথা বলেন।

৩. নব্য ভারতীয় আর্যভাষা—বাংলাসহ হিন্দি, গুজরাতি প্রভৃতি মধ্য ও উত্তর ভারতীয় আধুনিক ভাষাসমূহ : এই স্তরের সূচনাকাল খ্রিষ্টীয় ১০০০ অব্দ বলে মনে করা হয়। খ্রিষ্টীয় প্রথম সহস্রাদের শেষ প্রান্তে এসে মধ্য ভারতীয় আর্য ভাষাগুলোর বিভিন্ন অপভ্রংশ থেকে যেসব আধুনিক ভারতীয় ভাষার উদ্ভব ঘটে, বাংলা তাদের মধ্যে অন্যতম। যদিও ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে, সপ্তম শতকেই অর্থাৎ ৬০১-৭০০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে বাংলার জন্ম হয়। বাংলা ভাষার ইতিহাসকে সাধারণত তিন ভাগে ভাগ করা হয় :

ক. প্রাচীন বাংলা (৯০০/১০০০ খ্রিস্টাব্দ – ১৪০০ খ্রিস্টাব্দ)—লিখিত নিদর্শনের মধ্যে আছে চর্যাপদ, ভক্তিমূলক গান; আমি, তুমি, ইত্যাদি সর্বনামের আবির্ভাব; ক্রিয়াবিভক্তি -ইলা, -ইবা, ইত্যাদি। ওড়িয়া ও অসমীয়া এই পর্বে বাংলা থেকে আলাদা হয়ে যায়।

খ. মধ্য বাংলা (১৪০০–১৮০০ খ্রিস্টাব্দ)—এ সময়কার গুরুত্বপূর্ণ লিখিত নিদর্শন চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন; শব্দের শেষে “অ” ধ্বনির বিলোপ; যৌগিক ক্রিয়ার প্রচলন; ফার্সি প্রভাব। কোন কোন ভাষাবিদ এই যুগকে আদি ও অন্ত্য এই দুই ভাগে ভাগ করেন।

গ. আধুনিক বাংলা (১৮০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে)—ক্রিয়া ও সর্বনামের সংক্ষেপন (যেমন তাহার → তার; করিয়াছিল → করেছিল)। নব্য ভারতীয় আর্যভাষাগুলোর মধ্যে বাংলা ও মারাঠির শব্দভাণ্ডারে প্রচুর সংস্কৃত শব্দ রয়েছে; অন্যদিকে হিন্দি ও অন্যান্য ভাষাগুলো আরবি ও ফার্সি দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে।

হিন্দি এবং উর্দু নামে ভিন্ন হলেও যেন একই কুঁড়ির দুটি পাতা। প্রধান পার্থক্য লুকিয়ে আছে তাদের শব্দকোষ, লিপি, এবং ধর্মীয় ঐতিহ্যে। আধুনিক হিন্দির শব্দভাণ্ডার প্রধানত এসেছে সংস্কৃত থেকে, আর উর্দুর শব্দ বলতে বোঝায় মূলে যাদের ফার্সি এবং আরবি শব্দ; হিন্দি লেখা হয় দেবনাগরী লিপিতে, এবং উর্দু পার্সিয়ান-অ্যারাবিক লিপিতে। হিন্দি প্রধানত হিন্দুদের ভাষা; উর্দু ব্যবহারকারীদের মধ্যে মুসলিমরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ—ভারতে যেমন সমগ্র পাকিস্তানেও তেমনি। হিন্দি ভাষায় প্রায় এক শরও বেশি উপভাষা রয়েছে। তন্মধ্যে প্রধান দুটি হচ্ছে—পশ্চিমী হিন্দি যা উদ্ভূত হয়েছে দিল্লী অঞ্চল থেকে, এবং পূর্বাঞ্চলীয় হিন্দি যা মূলত মধ্য উত্তরপ্রদেশ এবং পূর্ব মধ্যপ্রদেশে ব্যবহৃত হয়। সিন্ধি মূলত বৈদিক সংস্কৃতের কয়েকটি উপভাষা থেকে সৃষ্টি।

সিন্ধের অবস্থান অবিভক্ত ভারতের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে হওয়ায় ভারতে আসা ‘কখনোই শেষ না হওয়া বহিরাগত’দের মিছিল সব সময়ই সিন্ধের ওপর দিয়ে এসেছে, এবং এভাবে হিন্দি, ফার্সি, আরবি, তুর্কি, ইংরেজি এবং পর্তুগিজ ভাষার বহু শব্দকে সিন্ধি আপন করে নিয়েছে।

তাই সিন্ধ মানেই সেই স্থান যেখানে পারস্যদেশীয় এবং ভারতীয় সংস্কৃতি এসে একসূত্রে মিশে গেছে। ভারতীয় আর্যভাষার অধিকাংশেরই লিপির সাথে সাযুজ্য রয়েছে ব্রাহ্মলিপির সাথে, যার উৎপত্তি ঘটেছে উত্তর সেমিটিক ভাষা থেকে। আবার এই ব্রাহ্মলিপি সংস্কার করেই দেবনাগরী লিপি তৈরি করা হয়েছে। বর্তমানে এই লিপিটিই হিন্দি, সংস্কৃত, প্রাকৃত ভাষাসমূহ, নেপালি, মারাঠি, কাশ্মিরি (হিন্দুদের) প্রভৃতি ভাষায় লেখার কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে।

বাংলা, আসামি, এবং ওড়িয়া সবারই নিজস্ব লিপি রয়েছে, যা মূলত দেবনাগরী লিপি থেকেই উদ্ভূত। পার্সিয়ান-অ্যারাবিক লিপি ব্যবহৃত হয় উর্দু, সিন্ধি (দেবনাগরীতেও লেখা হয়), এবং পাঞ্জাবি ভাষাতে। বাংলা সাহিত্যের সুচনাপর্ব শুরু হয় আর্য ও অনার্য সমন্বয়ের পর। ফলে বৈদিক সাহিত্যের ব্যপক প্রভাব বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন সমূহে দেখতে পাওয়া যায়।

১৯০৭সালে মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপালের রাজদরবার থেকে একটি পুঁথির খন্ডিত অংশ উদ্ধার করেন। আচার্য সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় ও ড: মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ভাষাতাত্ত্বিক বিশ্লেষনের মাধ্যমে বাংলার সাথে এর যুগসুত্র খুঁজে পান। প্রাপ্ত এই পুঁথির রচনাকাল নিয়ে উভয় তাত্ত্বিকের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়। সুনীতি কুমার এই আদি নিদর্শনের রচনাকাল খ্রিষ্টিয় দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দী বলে মনে করেন। আবার শহীদুল্লাহ এর রচনা শুরু ৬৫০সালে অর্থাৎ রচনা কালের ব্যপ্তি সপ্তম থেকে দ্বাদশ শতাব্দী বলে উল্লেখ করেন। নেপালের রাজদরবারে প্রাপ্ত এই পুঁথি আমাদের নিকট চর্যাপদ নামে পরিচিত। বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন হিসাবে এই চর্যাপদকেই বিশ্লেষকেরা মনে করে থাকেন।

আগেই বলেছি ,প্রাচীন ভারতবর্ষে সর্বসাধারণের কথ্যভাষা ছিল প্রাকৃত ভাষা। খ্রিষ্টপূর্ব ৪৫০ অব্দ থেকে ১০০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত একাধারে লিখিত ও কথ্য ভাষারূপে ভারতের নানা জায়গায় এ প্রাকৃত ভাষাসমূহ প্রচলিত ছিল। সাধারণ মানুষের কথ্যভাষা প্রাকৃত থেকেই বাংলা ভাষার উৎপত্তি। ধারণা করা হয় প্রাচীন ভারতের প্রাকৃত ভাষাগুলোর মধ্যে পালি অন্যতম, যার জন্ম খ্রিষ্টজন্মেরও কমপক্ষে ছ শ বছর আগে। পালি ছিল মধ্য বিহারের মগধ অধিবাসীদের মুখের ভাষা। পালি মুখ্যত কথ্য ভাষা হলেও তার সুনির্দিষ্ট ব্যাকরণ ছিল এবং তাতে কাব্য, নাটক ইত্যাদি রচিত হয়েছিল।

যুগ যুগ ধরে ভারতে (মূল অংশে) যেমন সংস্কৃতের কদর বা ইউরোপে ল্যাটিনের—গঙ্গার এপারে বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে পালিও ঠিক তা-ই আছে এখন পর্যন্ত, যেমনটি শত বছর ধরে ছিল। কিন্তু এত যে পুরোনো ভাষা, এত সুদূরব্যাপী যার বিস্তার, এবং এত সব মূল্যবান ঐতিহাসিক নিদর্শন যার রয়েছে সেই পালি তার যথাযথ মর্যাদা পায়নি।

সংস্কৃত ভাষা

তার সম্মানে কোনো রচনা প্রকাশিত হয় না। এমনকি গবেষক ও ভাষাতাত্ত্বিকদের নিকটও পালি যেন অনেটাই অপরিচিত। এই অসম্মান ও অনাদর পালির পাওনা ছিল না।

বলা হয়ে থাকে এসব ভাষা এসেছে পূর্ব ইউরোপ এবং পশ্চিম এশীয় অঞ্চলের সমভূমিতে ঘুরে বেড়ানো যাযাবর উপজাতির কাছ থেকে। এ অঞ্চলকে একসময় ‘গোবি’ও বলা হতো। এটি খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০০ সালের কথা। খ্রিষ্টপূর্ব ২০০০ সাল থেকে ইন্দো-ইউরোপীয় পরিবারের ভাষাভাষী লোকেরা ইউরোপ ছাড়িয়ে আটলান্টিকের উপকূল এবং ভূমধ্যসাগরের উত্তর কূলের দিকে আসতে শুরু করে। পারস্য ও ভারত জয়ের মধ্য দিয়ে তারা ছড়িয়ে যায় এশিয়ার দূর এলাকাসমূহে। সমসাময়িক সময়েই সিন্ধুর অধিবাসীগণও পূর্বদিকে (গাঙ্গেয় সমভূমি) এবং পশ্চিমদিকে (ইরান এবং আফগানিস্তান) ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। খ্রিষ্টপূর্ব ১০০০ অব্দের মধ্যে দুটি ভাষা-শাখা, ভারতীয় আর্যভাষা (ইন্দো-আর্য) এবং ইন্দো-ইরানীয় ভাষা, আলাদা হয়ে যায়।

ভারতীয় আর্যভাষার ইতিহাসে তিনটি প্রধান স্তর লক্ষ করা যায়।

১. প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষা—বৈদিক এবং সংস্কৃত ভাষার স্তর : সংস্কৃতের প্রাচীন রূপই হচ্ছে বৈদিক ভাষা, যা প্রচলিত ছিল আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ১৫০০ অব্দ থেকে খ্রিষ্টপূর্ব ৫০০ অব্দ পর্যন্ত। বৈদিক ভাষায় প্রথম ইন্দো-ইউরোপীয় কাব্য/ধর্মগ্রন্থ বেদ রচিত হয়েছিল। এ ভাষাটি যখন সাধারণ মানুষের কাছে দুর্বোধ্য হয়ে ওঠে তখন ব্যাকরণবিদগণ নানা নিয়ম বিধিবদ্ধ করে একটি মানসম্পন্ন ভাষা সৃষ্টি করেন, যার নাম সংস্কৃত। খ্রিষ্টপূর্ব ৪০০ অব্দের দিকে এ ভাষাটি চূড়ান্তভাবে বিধিবদ্ধ হয় ব্যাকরণবিদ পাণিনির হাতে। মূলত সংস্কৃত ছিল সাহিত্য এবং প্রায়োগিক কৌশলসংক্রান্ত কাজের ভাষা।

প্রাকৃত ভাষার যুগেও (যার শুরু আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ৬০০ অব্দ থেকে) সাহিত্যের ভাষা ও শিক্ষিত জনের ভাবপ্রকাশের মাধ্যম হিসেবে এর ব্যবহার ছিল। শিক্ষিত লোকজন সংস্কৃত ও প্রাকৃত এই উভয় ভাষাই জানতেন এবং প্রয়োজনে যে কোনো একটি ভাষা ব্যবহার করতেন। অনেকটা আমরা যেমন ‘মান বাংলা’ আর ‘আঞ্চলিক বাংলা’ এই দুই ভাষাই ব্যবহার করে থাকি বা করতে পারি তেমন। খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় শতকে রচিত কালিদাসের কাব্য ও নাটকের ভাষা ছিল সংস্কৃত। রামায়ণ ও মহাভারত সংস্কৃত ভাষাতেই রচিত হয়েছে। এমনকি এত কাল পরেও সংস্কৃত ভারতে ব্যাপকভাবে পঠিত/চর্চিত এবং একটি পবিত্র ভাষা হিসেবে স্বীকৃত।

২. মধ্য ভারতীয় আর্যভাষা—পালিসহ অন্যান্য প্রাকৃত ভাষার স্তর (অপভ্রংশ) : ধারণা করা হয় এই স্তরের সূচনাকাল খ্রিষ্টপূর্ব আনুমানিক ৬০০ অব্দ। জৈন ধর্মের অনেক গ্রন্থ ও বৌদ্ধ ধর্মের প্রধান ধর্মগ্রন্থ ত্রিপিটক প্রাকৃত পালি ভাষায় লেখা। মনে করা হয়, খ্রিষ্টপূর্ব ৫৩৭ অব্দে বোধি লাভ করে সিদ্ধার্থ গৌতম ‘বুদ্ধ’ নামে পরিচিত হন। একই সময় চতুর্বিংশতিতম জৈন তীর্থঙ্কর মহাবীর একই ধরনের অপর একটি ধর্মতত্ত্ব প্রচার করেন; পরবর্তীকালে যা জৈনধর্ম নামে পরিচিত হয়। বুদ্ধের শিক্ষা ও জৈন ধর্মতত্ত্ব নির্বাণতত্ত্বের কথা বলে। প্রাকৃত ভাষায় রচিত হওয়ায় তাঁদের ধর্মমত সহজেই সর্বজনগ্রাহ্য হয়ে উঠতে সক্ষম হয়।

সংস্কৃত ব্যাকরণবিদ পতঞ্জলির মহাভাষ্য গ্রন্থে সর্বপ্রথম “অপভ্রংশ” শব্দটির উল্লেখ পাওয়া যায়। তিনি সংস্কৃত থেকে উদ্ভূত কিছু অশিষ্ট শব্দকে নির্দেশ করার জন্য শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। বর্তমান ভাষাবিদদের মতে সমস্ত প্রাকৃত ভাষারই শেষ স্তরটি হল অপভ্রংশ এবং এই অপভ্রংশগুলি থেকেই সমস্ত নব্য ইন্দো-আর্য ভাষা উদ্ভূত হয়েছিল।

উদাহরণস্বরূপ, পূর্ব ভারতে প্রচলিত মাগধী প্রাকৃত ভাষা থেকে পূর্বী অপভ্রংশ উদ্ভূত হয়েছিল এবং সেই পূর্বী অপভ্রংশ থেকে মগহী, মৈথিলী ও ভোজপুরী—এই তিনটি বিহারী ভাষা এবং বাংলা, অসমীয়া ও ওড়িয়া—এই তিনটি গৌড়ীয় ভাষার উৎপত্তিলাভ ঘটে। অন্যদিকে, পশ্চিমের শৌরসেনী অপভ্রংশ থেকে হিন্দি ও অন্যান্য নব্য ইন্দো-আর্য ভাষার উদ্ভব হয়।

অপভ্রংশ খ্রিষ্টীয় দ্বাদশ শতক পর্যন্ত প্রচলিত ছিল, যদিও খ্রিষ্টীয় দশম শতক থেকেই আধুনিক আর্যভাষাগুলো বিকশিত হতে শুরু করেছিল। ভাষার সংখ্যা অননুমেয় হলেও হিন্দি, উর্দু, বাংলা, বিহারি, গুজরাতি, কানাড়া, মালয়ালাম, মারাঠি, ওড়িয়া, পাঞ্জাবি, রাজস্থানি, তামিল, এবং তেলেগুর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এসব ভাষার প্রত্যেকটিতেই বর্তমানে এক কোটিরও বেশি লোক কথা বলেন।

৩. নব্য ভারতীয় আর্যভাষা—বাংলাসহ হিন্দি, গুজরাতি প্রভৃতি মধ্য ও উত্তর ভারতীয় আধুনিক ভাষাসমূহ : এই স্তরের সূচনাকাল খ্রিষ্টীয় ১০০০ অব্দ বলে মনে করা হয়। খ্রিষ্টীয় প্রথম সহস্রাদের শেষ প্রান্তে এসে মধ্য ভারতীয় আর্য ভাষাগুলোর বিভিন্ন অপভ্রংশ থেকে যেসব আধুনিক ভারতীয় ভাষার উদ্ভব ঘটে, বাংলা তাদের মধ্যে অন্যতম। যদিও ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে, সপ্তম শতকেই অর্থাৎ ৬০১-৭০০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে বাংলার জন্ম হয়।

খ্রিষ্টপূর্ব ১৫০০ অব্দের দিকে আর্যরা ভারতবর্ষে আসা শুরু করেছিল। উত্তর-পশ্চিম ভারত দিয়ে এই আগত এই জনগোষ্ঠী খ্রিষ্টপূর্ব ১১০০ অব্দের দিকে বঙ্গদেশ পর্যন্ত পৌঁছেছিল। খ্রিষ্ট-পূর্ব ১০০০ বৎসরের ভিতরে ভারতীয় ইন্দো-ইরানিয়ান ভাষার পরিবর্তন ঘটে। এই সময়ের ভিতরে এই পরিবর্তিত ভাষার নমুনা পাওয়া যায় ঋগ্বেদ।

ধারণা করা হয়- ঋগ্বেদের শ্লোকগুলো রচিত হয়েছিল খ্রিষ্ট-পূর্ব ১২০০-১০০০ বৎসরের ভিতরে। বিভিন্ন ঋষিদের রচিত বিভিন্ন শ্লোকগুলো একত্রিত করে যে সংকলিত গ্রন্থ প্রস্তুত করা হয়, তাই ঋগ্বেদ নামে পরিচিতি লাভ করে। এরপর লেখা হয় অন্য তিনটি বেদ এবং এর সাথে সম্পর্কিত অন্যান্য গ্রন্থ। গোড়ার দিকে সকল বেদ সংকলিত হয়ে একটি বেদ-আকারে ছিল। বেদের এই ভাষাকে বলা হয় বৈদিক ভাষা।

বৈদিকভাষার যুগে আর্য ঋষিদের সাথে সাধারণ আর্যদের যতটা যোগাযোগ ছিল, কালক্রমে তা অনেকটা শিথিল হয়ে পড়েছিল। বৈদিক ভাষা সাধারণ মানুষের মুখের ভাষা না হয়ে সাহিত্যের ভাষা হয়ে উঠেছিল। এর ফলে বৈদিক ভাষার নানা ধরনের কথ্যরূপ তৈরি হয়েছিল ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে। খ্রিষ্টপূর্ব ৬০০-৫০০ অব্দের ভিতরে বৈদিক ভাষা থেকে বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষার সৃষ্টি হয়েছিল। ব্যাকরণ দিয়ে এই ভাষার রীতি নীতি অনেকে বাঁধার চেষ্টাও করেছিলেন অনেকে। এক্ষেত্রে পাণিনি সফল হয়েছিলেন। তাঁর সাফল্য সাময়িকভাবে বৈদিক ভাষাকে জীবন্ত করেছিল বটে, দীর্ঘজীবী করতে ব্যর্থ হয়েছে।

পাণিনি ‘অষ্টাধ্যায়ী’ নামক একটি ব্যাকরণ রচনা করেছিলেন খ্রিষ্টপূর্ব ৫০০-৪০০ অব্দের দিকে। এই ব্যাকরণের সূত্রে বৈদিক সংস্কৃতি বিবর্তনের ভিতর দিয়ে একটি পরিমার্জিত ও পরিশীলিতরূপ লাভ করেছিল। পাণিনির পূর্বে বা সমসাময়িককালে সংস্কৃত ভাষার তিনটি কথ্য রূপ গড়ে উঠেছিল।

১। প্রাচ্য: এই রূপটি প্রচলিত ছিল পূর্বভারতের অযোধ্যা, উত্তর ভারতের পূর্বাঞ্চলের বিহার এবং তৎসংলগ্ন অঞ্চল।

২। উদীচ্য: উত্তর-পশ্চিম ভারত ও উত্তর পাঞ্জাব।

৩। মধ্যদেশীয় : পশ্চিম ভারতের মধ্যদেশ, দিল্লী, মীরাট, মথুরা এবং তৎসংলগ্ন অঞ্চল।

সুনীতি চট্টোপাধ্যায় ভারতের মহারাষ্ট্র অঞ্চলে সংস্কৃত ভাষার অপর একটি রূপ ছিল বলে অনুমান করেছেন। তিনি এর নাম দিয়েছেন দাক্ষিণ্যাত্য।

ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ তাঁর বাঙ্গালা ভাষার ইতিবৃত্ত গ্রন্থে একটি সারণীতে আর্য ভাষার থেকে বাংলা ভাষার ক্রমবিবর্তনের ধারায় যে তথ্য উপাস্থাপন করেছেন, সেই তথ্যানুসরণে নিচের তালিকাটি দেওয়া হলো।

১। ইন্দো-ইউরোপিয়ান ভাষা (খ্রিষ্টপূর্বাব্দ ৩৫০০-২৫০০)

২। শতম (খ্রিষ্টপূর্বাব্দ ২৫০০-১২০০)

৩। আর্য (খ্রিষ্টপূর্বাব্দ ২০০০-১২০০)

৪। প্রাচীন ভারতীয় আর্য (খ্রিষ্টপূর্বাব্দ ১২০০-৮০০)

৫। আদিম প্রাকৃত (খ্রিষ্টপূর্বাব্দ ৮০০-৫০০)

৬। প্রাচীন প্রাচ্য প্রাকৃত (খ্রিষ্টপূর্বাব্দ ৫০০-২০০ খ্রিষ্টাব্দ) এবং পালি

৭। গৌড়ী প্রাকৃত (২০০-৪৫০ খ্রিষ্টাব্দ)

৮। গৌড় অপভ্রংশ (৪৫০-৬৫০ খ্রিষ্টাব্দ)

৯। প্রাচীন যুগ (৬৫০-১২০০ খ্রিষ্টাব্দ)

১০। সন্ধিযুগ (১২০০-১৩৫০ খ্রিষ্টাব্দ)

১১। মধ্যযুগ (১৩৫০-১৮০০খ্রিষ্টাব্দ)

১২। নব্যযুগ (১৮০০)

সংস্কৃত ভাষার প্রাচ্য রূপটি প্রচলিত ছিল পূর্বভারতের অযোধ্যা, উত্তর ভারতের পূর্বাঞ্চলের বিহার এবং তৎসংলগ্ন অঞ্চল। আধুনিক ভাষা বিজ্ঞানীরা মনে করেন ‘ভারতীয়-আর্য ভাষা’র ‘পূর্বাঞ্চলীয় শাখা’য় (প্রাচ্য) পৃথকভাবে বাংলা-অহমীয়া প্রাকৃত ভাষার সৃষ্টি হয়েছিল। এই প্রাকৃত রূপটি কি ছিল তা নিয়ে ব্যাকরণবিদের মধ্য মতবিরোধ আছে। যেমন সুনীতিকুমার চট্টোপধ্যায়ের মতে: ” মাগধী প্রাকৃত থেকেই বাংলা ভাষার উদ্ভব হয়েছে”।

আর ড. শহীদুল্লাহর মতে: “গৌড়ীয় প্রাকৃত হতেই গৌড়ীয় অপভ্রংশের মাধ্যমে বাংলা ভাষার উদ্ভব হয়েছে “। কিন্তু উভয়ই মনে করেন যে, বাংলা-অহমিয়া ভাষা ভাষাগোষ্ঠীই বিভাজিত হয়ে বাংলা এবং অহমিয়া নামক দুটি ভাষার জন্ম হয়েছে।

মূলত ভারতের বিবর্তিত আর্য ভাষার অন্যান্য শাখার মতোই পূর্বাঞ্চলীয় শাখার কথ্যরূপ, স্থানীয় অনার্য ভাষাভাষীদের সংমিশ্রণে গড়ে উঠছিল। কালক্রমে উভয়ের সংমিশ্রণে সৃষ্টি হয়েছিল পূর্বাঞ্চলীয় প্রাকৃত ভাষা। বাংলা-অহমিয়া ভাষা হলো বাংলা ভাষার সর্বশেষ প্রাকৃত ভাষার একটি রূপ। খ্রিষ্টীয় ৫০০-৬০০ অব্দের দিকে বাংলা ভাষা একটি স্বতন্ত্র ভাষায় রূপ নিয়েছিল।

ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে ৬৫০ খ্রিষ্টাব্দের পর থেকে বাংলা ভাষার প্রাচীন যুগের সূচনা হয়েছিল। সুনীতি চট্টোপাধ্যায়ের ভাষা-প্রকাশ বাঙ্গালা ব্যাকরণ (রূপম, ১৩৯৬) গ্রন্থ মতে- খ্রিষ্টীয় ৬০০ অব্দের পরে প্রাকৃত ভাষা পরিবর্তিত হয়ে যে রূপ লাভ করেছিল, সেই রূপটিই অপভ্রংশ। আর চর্যাপদের রচনাকালকে তিনি ৯০০-১২০০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে রচিত বলে অনুমান করেছেন।

তাঁর মতে এর আগে উত্তর বিহারের মৈথিলী, দক্ষিণ বিহারের মগহী, পশ্চিম বিহারের ভোজপুরিয়া, উড়িষ্যার উড়িয়া ও আসামের আসামী ভাষা মিলে একটি ভাষা ছিল। সুনীতি চট্টোপাধ্যায় এর নামকরণ করেছেন মাগধী অপভ্রংশ। বাঙালী এই দুই প্রধান ভাষাতাত্ত্বিক ছাড়াও দেশী বিদেশী বহু ভাষাতাত্ত্বিক ভিন্ন ভিন্ন তথ্য উপস্থাপন করেছেন।

খ্রিষ্টপূর্ব ৬০০ অব্দের পরের দিকে সংস্কৃত সাহিত্যিকরা প্রাকৃত ভাষার বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে উপেক্ষা করতে পারেন নাই। তাঁরা প্রাকৃতভাষাকে অশিক্ষিতের ভাষা হিসাবে বিবেচনা করেছেন, কিন্তু সংস্কৃত সাহিত্যে তার নমুনাও হাজির করেছেন, সংস্কৃত নাটকে হাস্য-কৌতুকের ভাষা হিসাবে প্রাচীন মাগধী ভাষাকে ব্যবহার করেছেন। ভারতবর্ষের সকল প্রান্তের প্রাকৃত ভাষা একইভাবে বিকশিত হয় উঠে নি।

ভাষার এই ব্যবধান লক্ষ্য করে পাণিনি প্রাকৃতভাষাকে প্রাচ্যাং ও উদীচ্যাং নামে চিহ্নিত করেছিলেন। স্থানীয় অনার্য ভাষা তথা প্রাকৃত ভাষার কালানুক্রমিক বিকাশের আদি অধ্যায় অজ্ঞাতই রয়ে গেছে। এই সংস্কৃতের সংস্পর্শে এসে প্রাকৃত ভাষার যে মিশ্ররূপ তৈরি হয়, তাকেই অপভ্রংশ ভাষা হিসাবে বিবেচনা করা যেতে পারে।

চর্যাপদ

যে কোনো ভাষার ক্রমবিবর্তনের ধারা জানতে গেলে, তার লিখিত বা শ্রবণ নমুনা দরকার। সে আমলের শ্রবণ নমুনা সংগ্রহের কোনো পদ্ধতি ছিল না। তাই সেকালের ভাষারীতি জানার জন্য প্রয়োজন পড়ে লিখিত নমুনা। এখন পর্যন্ত বাংলা ভাষার সর্বপ্রাচীন যে নমুনা পাওয়া গেছে তা হলো- চর্যাগীতি বা চর্যাপদ। ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ-এর মতে ” আমি বাঙ্গালা সাহিত্যের আরম্ভ ৬৫০ খ্রীঃ অঃ বলিয়া নির্দেশ করিয়াছি। নাথ-গীতিকার উদ্ভব বৌদ্ধযুগে। কিন্তু আমরা তাহা পাই নাই। আমরা বৌদ্ধযুগের একটি মাত্র বাঙ্গালা পুস্তক পাইয়াছি। ইহার নাম আশ্চর্যচর্যাচয়।” চর্যাগীতির রচনাকাল নিয়ে নানা পণ্ডিতের নানা মত আছে।

বিভিন্ন গবেষকদের আলোচনার সূত্রে চর্যাপদের একটি কালসীমা নিতে পারি ৬০০-১২০০ খ্রিষ্টাব্দ। একটি ভাষায় কবিতা লেখার প্রান্তীক সময় যদি ৬০০ খ্রিষ্টাব্দ ধরে নেই। তাহলে বুঝতে হবে ওই ভাষাটা আদি অবস্থা থেকে অন্তত কবিতা লেখার পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছাতে অন্তত ১০০ বৎসর অতিক্রম করেছে। তাহলে বাংলা আদিরূপটি গড়ে উঠার জন্য ৫০০ অব্দ ধরে নেওয়া যেতে পারে।

বাংলা ভাষার ক্রমবিবর্তনের কালানুক্রমিক ধারা

চর্যাগীতি ‘কে বাংলার প্রাচীন নমুনা হিসেবে স্বীকার করে নিয়ে, তার পরবর্তী নমুনা অনুসারে বাংলা ভাষাকে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এই ভাগ তিনটি হলো- প্রাচীন যুগ, মধ্যযুগ ও আধুনিক যুগ।

১। প্রাচীন যুগ (৬৫০-১২০০ খ্রিষ্টাব্দ): চর্যাগীতি বা চর্যাপদের ভাষার নমুনা এবং প্রাচীনত্বের বিচারে প্রাচীন যুগকে চিহ্নিত করা হয়েছে। কালের বিচারে বলা যায়, ১২০০ খ্রিষ্টেব্দের পূর্বর্তী বাংলা ভাষার নমুনাসমূহকে প্রাচীন নমুনা হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে।

অন্ধকার যুগ (১২০২-১৩৫০ খ্রিষ্টাব্দ): চর্যাগীতি র নমুনা পাওয়ার পর একটি দীর্ঘ সময় পর্যন্ত বাংলা ভাষার কোনো নমুনা পাওয়া যায় নি। এই সময়কে মোটা দাগে অন্ধকার যুগ বলা হয়। এই নমুনা না পাওয়ার কারণ হিসেব দেখিয়েছেন বঙ্গদেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক অস্থিরতা। এই সময়ে বাংলাদেশে যুদ্ধবিগ্রহ তথা অস্থিরতার মধ্য দিয়ে অতবাহিত হয়েছে, তা এই সময়ের বাংলার ইতিহাসের দিকে তাকালেই বুঝা যায়।

অন্ধকারযুগের বাংলা :এর সূচনা হয়েছিল ১২০২ খ্রিষ্টাব্দে ইখতিয়ার উদ্দীন বখতিয়ার খিলজি নদীয়া আক্রমণের মধ্য দিয়ে। নদীয়ার রাজা লক্ষ্মণসেন পালিয়ে জীবন রক্ষা করেন। এরপর তিনি বাংলার রাজধানী গৌড় দখল করেন।

বখতিয়ার খিলজির সৈন্যরা এই সকল অঞ্চলে ব্যাপক হত্যা ও লুণ্ঠন করে। ফলে বহুলোক পুর্ববঙ্গ ও কামরূপে পালিয়ে যায়। ১২০৫ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে তিনি ধীরে পশ্চিম ও উত্তরবঙ্গ দখল করে নেন। এরপর তিনি তিব্বত আক্রমণ করে জয়লাভ করলেও তার জন্য বিপর্যয় দেকে আনে। শেষ পর্যন্ত বখতিয়ার তার অনুচর আলী মর্দানের হাতে নিহত হন।

এরপর বখতিয়ারে অপর অনুচর সিরান আলী মর্দানকে পরাজিত ও বন্দী করে করে ১২০৭ খ্রিষ্টাব্দে সিংহাসনে বসেন। মর্দান পরে ছাড়া পেয়ে দিল্লীর রাজা কুতুব-উদ্দিন আইবেক-কে সন্তুষ্ট করে, বাংলার শাসনকর্তার পদ লাভ করেন। ১২১০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে বাংলায় এলে সিরান তার হাতে বাংলার ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। দিল্লীতে কুতুব-উদ্দীন মৃত্যুবরণ করলে, ১২১৩ খ্রিষ্টাব্দে গিয়াসউদ্দিন প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে মার্দানকে হত্যা করে বাংলার সিংহাসন লাভ করেন। দিল্লীর সুলতান ইলতুৎমিস ১২২৫ খ্রিষ্টাব্দে গিয়াসউদ্দিনের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন। গিয়াসউদ্দিন শান্তি চুক্তি করলে ইলতুৎমিস দিল্লীতে ফিরে যাওয়ার পর গিয়াসউদ্দিন দিল্লীর আনুগত্য অস্বীকার করেন।

ফলে ১২২৭ খ্রিষ্টাব্দে ইলতুৎমিসের পুত্র নাসিরউদ্দিনের কাছে পরাজিত ও সপরিবারের নিহত হন। এরপর ১২২৯ খ্রিষ্টাব্দে নাসিরুদ্দিনের মৃত্যু হয়। এরপর বল্কা নামক এক সেনাপতি দিল্লীর আধিপত্য অগ্রাহ্য করে বাংলার সিংহাসন দখল করেন। ১২৩০ খ্রিষ্টাব্দে ইলতুৎমিশ বিদ্রোহী বল্কাকে পরাজিত করে হত্যা করেন। এই সময় আলাউদ্দিন-জনিকে বাংলার শাসনকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়।

১২৩৬ খ্রিষ্টাব্দে ইলতুৎমিশ মৃত্যবরণ করেন। এরপর বিহারের শাসনকর্তা তুঘ্রাল-তুঘান খান, দায়িত্বপ্রাপ্ত বাংলার শাসনকর্তা আওর খাঁ আইবেককে পরাজিত করে বাংলার সিংহাসন দখল করেন। তিনি কৌশলে দিল্লীর সুলাতানা রাজিয়ার কাছ থেকে বাংলা শাসনের অধিকারও লাভ করেন। অন্তর্দ্বন্দ্বের সূত্রে তুঘান খাঁ পদত্যাগ করেন এবং তার জায়গায় তমর খাঁ শাসনকর্তার হিসেবে নিয়োজিত হন। এরপর মুঘিশউদ্দিন উজবেক শাসনক্ষমতা লাভ করেন ১২৫১ খ্রিষ্টাব্দে। ১২৫৭ খ্রিষ্টাব্দে কামরূপ রাজার সাথে যুদ্ধে নিহত হন।

১২৬৬ খ্রিষ্টাব্দে বলন দিল্লীর সিংহাসন লাভ করেন। এই সময় বাংলার শাসনকর্তা ছিলেন আমিন খাঁ। আমির খাঁর সহকারী তুঘ্রাল খাঁ পূর্ববঙ্গে অভিযান চালিয়ে ঢাকা, ফরিদপুর অঞ্চল দখল করে নেন। পরে তিনি ত্রিপুরা দখল করেন। দিল্লীতে বলবন মৃত্যবরণ করেছে, এই মিথ্যা সংবাদের ভিত্তিতে তুঘ্রাল বিদ্রোহ ঘোষণা করেন এবং আমিন খাঁকে বিতারিত করেন।

১২৮০ খ্রিষ্টাব্দে তুঘ্রালের বিরুদ্ধ বলবন অভিযান পরিচালনা করেন। যুদ্ধে তুঘ্রাল বন্দী হন। পরে বলবন তাঁকে সপরিবারে হত্যা করেন। ১২৮৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বলবনের পুত্র বঘরা খাঁ দিল্লীর প্রতিনিধি হিসেব বাংলা শাসন করেন। ১২৮৭ খ্রিষ্টাব্দে বলবন মৃত্যবরণ করলে, বঘরা খাঁ বাংলার স্বাধীন সুলতান হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। এরপর ১৩২৪ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বঘরা খাঁ’র উত্তরাধিকাররা বাংলাদেশের স্বাধীন সুলতান হিসেবে নির্বিবাদে রাজত্ব করেন।

১৩২৪ খ্রিষ্টাব্দে দিল্লীর সুলতান গিয়াঢসউদ্দিন তুঘলক বাংলা আক্রমণ করে, তৎকালীন বাংলার সুলতান বাহাদুরকে পরাজিত করেন। বাহাদুর শাহকে প্রথমাবস্থায় গিয়াসউদ্দিন দিল্লীতে নিয়ে যান। পরে বাংলার শাসন ব্যাবস্থা সুদৃঢ় করার জন্য বাংলার শাসনকর্তা বহরম শাহ সহযোগী হিসেবে নিয়োগ দেন। কিন্তু বাংলা ফিরে বাহাদুর পুনরায় বাংলার অধিকার লাভ করার চেষ্টা করলে, বহরম শাহ তাঁকে হত্যা করেন। এই সময় বাংলদেশ লক্ষ্ণণাবতী, সাতগাঁ এবং সোনারগাঁও নামে তিনটি অঞ্চলে ভাগ করা হয়েছিল। ১৩৩৮ খ্রিষ্টাব্দে বহরম শাহ্ মৃত্যুবরণ করেন। এই সময় ফকরুদ্দিন নামক এক সেনাপতি সোনারগাঁও থেকে নিজেকে স্বাধীন সুলতান হিসেব ঘোষণা দেন। ফলে লক্ষ্ণণাবতীর শাসক কাদর খাঁ ও সাতগাঁও-এর শাসক ইজউদ্দিন যৌথ আক্রমণ করে ফকরুদ্দিনকে বিতারিত করেন।

এই সময় কাদর খাঁ দিল্লীর প্রতিনিধ হিসেব লক্ষ্ণণাবতী ও সোনারগাঁও শাসন করেন। এক সেনাবিদ্রোহে কাদর খাঁ নিহত হলে, আলিমোবারক লক্ষ্মণাবতীর শাসক হন। এই সময় সমগ্র সুলতানি সাম্রাজ্যে অরাজকতার সৃষ্টি হলে, মোবারক বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। ইতিমধ্যে ইলিয়স শাহ নামক তাঁর পালিত ভাই দিল্লী থেকে এসে মোবারককে পরাজিত করে লক্ষ্মণাবতীর শাসনভার গ্রহণ করেন। ১৩৪২ খ্রিষ্টাব্দ ইলিয়াস শাহ বাংলার স্বাধীন সুলতান হিসেবে রাজত্ব শুরু করেন। এই সময়ের পর থেকে বাংলাদেশ ক্রমে ক্রমে সুস্থির অবস্থায় আসতে থাকে। ফলে বাংলাতে পুনরায় সাহিত্য চর্চা শুরু হয়। এই দীর্ঘসময় বাংলায় কোনো কিছু রচিত হয় নি এমনটা বিশ্বাস হয় না। কিন্তু কোনো নমুনা না পাওয়ার কারণেই এমনটা ভাবতেই হয়।

২। মধ্যযুগ (১৩৫০-১৮০০খ্রিষ্টাব্দ): রাজকীয় শক্তি হিসেবে মুসলমানদের বাংলাদেশে আসার আগে, বাংলাদেশে মূলত দুটি ধর্ম প্রচলিত ছিল। এর একটি বৌদ্ধধর্ম অপরটি সনাতন ধর্ম। সনাতন ধর্ম আবার নানা ভাগে বিভক্ত ছিল। যেমন শৈব, শাক্ত, বৈষ্ণব সৌর ইত্যদি। এছাড়াও ছিল বর্ণমূলক প্রভেদ। এর প্রধান চারটি রূপ ছিল ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র। সাধারণ মানুষের সাধারণ কথোপকথনে একটি কথ্য ভাষারীতি গড়ে উঠেছিল। কিন্তু ধর্মাচরণের জন্য বৌদ্ধদের ভিতর পালি এবং সনাতন ধর্মালম্বীদের ভিতর প্রচলন ছিল সংস্কৃত ভাষার প্রচল ছিল।

এই ধারায় বাংলা সাহিত্যে একটি অন্যতম নমুনা হিসেবে উল্লেখ করা হয় বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন। বড়ু চণ্ডীদাস তৎকালীন অন্যান্য কবি বিদ্যাপতি, গোবিন্দ দাসের চেয়ে বয়সে বড় ছিলেন। তবে চণ্ডীদাস যে কতজন ছিলেন এ নিয়ে নানা মত রয়েছে। যতজনই থাক শ্রীকৃষ্ণকীর্তন -এ আরবি, ফারসি, তুর্কি শব্দের নমুনা পাওয়া যায় না। তাই ধরে নেওয়া যায়, বাংলাদেশে মুসলমানদের আধিপত্য বিস্তারের আগেই এই কাব্য রচিত হয়েছিল।

আবার এর ভাষা চর্যাগীতির ভাষার চেয়ে পরবর্তী ধাপের এটাও অনুমান করা যায়। তাই বাংলা সাহিত্যের অন্ধকার যুগ থেকে মধ্যযুগের শুরুর যে কোনো সময় এই কাব্যটি রচিত হয়েছিল বলে অনুমান করা যায়। পরবর্তী সময় মধ্যযুগীয় আরও কিছু কবি বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করেছিলেন। এঁরা ছিলেন চণ্ডীদাস, বিদ্যাপতি, গোবিন্দ দাস প্রমুখ।

বাংলাদেশে মুসলমানদের শাসনমালে নিম্নবর্ণের হিন্দুদের বিশাল অংশ মুসলমান হয়ে গিয়েছিল। একই সাথে বৌদ্ধদের প্রভাব কমে গিয়েছিল আশঙ্কাজনকভাবে। মুসলমানরা সুলাতনরা বৌদ্ধ এবং মুসলমান ছাড়া বাকি জনগোষ্ঠীর নাম দিয়েছিল হিন্দু। এই হিন্দু শব্দটি তারা আমদানি করেছিল পারশ্য থেকে। উত্তর-পশ্চিম ভারতে তা ব্যাপকভাবে গৃহীত হয়েছিল আগেই। বাংলাদেশে এই শব্দটি সনাতনধর্মীরাও গ্রহণ করে নিয়েছিল। এই সময় হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ভিতর পৌরাণিক দেবদেবীর সাথে মিশে গিয়েছিল বাংলার লোকজ দেবদেবী এবং এদের উপখ্যান। চণ্ডী, বাসুলি, বিষয়রি বা মনসার মতো লৌকিক দেবদেবীরা বিশেষ স্থান দখল করে নিয়েছিল। মধ্যযুগে ধর্মানতরিত মুসলমানরাও এই সকল লৌকিক দেবদেবীর অনুরক্ত ছিল।

আফগান শাসনামলের শেষের দিকে হিন্দু-মুসলমানের ঐক্যের সূত্রে সত্যপীরের পূজা চালু হয়েছিল। ১৪৮৬ খ্রিষ্টাব্দে শ্রীচৈতন্যদেবের জন্ম হয়। তাঁর প্রচারিত বৈষ্ণব মত প্রাচীনপন্থী হিন্দুদের উজ্জীবিত করেছিল। অনেকে সনাতন ধর্মী চৈতন্যদেবের বৈষ্ণব মতকে সানন্দে গ্রহণ করতে পারেন নি। হিন্দু ধর্মের অভ্যন্তরীণ বিভাজন এবং মুসলমাদের প্রভাব মিলিত হয়ে একটি মিশ্র ধারা বাংলা সঞ্চলিত হয়েছিল। এই সকল বৈষ্ণব ভক্তরা তাঁদের মতামত প্রতিষ্ঠা ও প্রচারের জন্য রচনা করেছিলেন বৈষ্ণব পদাবলী। মুসলমান সাধক কবিরা তাঁদের মতকে প্রকাশ করার জন্য রচনা করেছিলেন ধর্ম সাহিত্য। হিন্দু ভক্ত কবিরা রচনা করেছিলেন মঙ্গলকাব্য। কিন্তু আদৃত হয়েছিল উভয় সম্প্রদায়ের মানুষকে।

মঙ্গল কাব্য:

হিন্দুধর্মের ভক্ত কবিরা দেবতার আরাধনা, মাহাত্য-কীর্তন নির্ভর কাব্য। যা শ্রবণেও মঙ্গল হয়, এমন কি, যে কাব্য যার ঘরে রাখলেও মঙ্গল হয়, এমন বিশ্বাস গড়ে উঠেছিল এই কাব্য। মঙ্গলকাব্য ৫টি অংশে বিভাজিত ছিল। এর প্রথম অংশে ছিল দেব-দেবীর বন্দনা এবং দেবেদবীর উদ্দেশ্য কাব্যের উৎসর্গ বাণী। দ্বিতীয় অংশে ছিল কোনো কবি কর্তৃক কোনো আখ্যানের বর্ণনা। এই অংশে কবি নিজের পরিচয় তুলে ধরেন এবং যে দৈব দর্শনে তিনি কবিতা লিখতে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন তার বর্ণনা। তৃতীয় অংশ দেবখণ্ড। এতে এক ঈশ্বরের সাথে স্থানীয় দেবীর সম্পর্কের বহিঃপ্রকাশ বর্ণনা করে।

এই অংশের একটি পরিচিত অংশ হিসেবে প্রভু শিব সর্বদা একবার দর্শন দেন এই অংশে। চতুর্থ অংশে প্রধান বর্ণনা থাকে, সাধারণত এখানে দেবী অভিশপ্ত হয়ে স্বর্গ থেকে পতিত হন এবং স্বর্গীয় ধর্ম বিচ্যুত হন। তিনি তখন পুণর্জাগরণে নিমজ্জিত হন এবং মরণশীল হিসেবে পৃথিবীতে জীবনযাপন করেন। চূড়ান্তভাবে তিনি নিজেকে অর্চনীয় এক দেবী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। এই গল্পের আরেক গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল তার কষ্ট ও কষ্টমোচন, এবং তার চরিত্র ও ব্যবহারের বর্ণনা দেয়া হয়। অধিকাংশ মঙ্গল কাব্য সাধারণ পয়ার ছন্দে রচিত।

মঙ্গলকাব্য (ধর্মমঙ্গল):

মঙ্গলকাব্যের একটি ধারায় শুধু হিন্দু ধর্মের পৌরাণিক আখ্যানের সাথে ধর্মীয় আদর্শ প্রাচারের উদ্দেশ্যে রচিত হতো। এই জাতীয় মঙ্গলকাব্যকে ধর্মমঙ্গল নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে। এই ধারার কবিরা ছিলেন‒ আদি রূপরাম, কানাহরি দত্ত, খেলারাম, ঘনরাম চক্রবর্তী, দ্বিজ বংশী দাস, দ্বিজ প্রভারাম, দ্বিজ মাধব, বিজয়গুপ্ত, বিপ্রদাস পিপলাই, ময়ূর ভট্ট, মানিকরাম গাঙ্গুলি, রূপরাম, শ্যামপণ্ডিত, শ্রীশ্যাম পণ্ডিত, সীতারাম দাস। এঁদের ভিতর সর্বপ্রাচীন কবি ছিলেন ময়ুর ভট্ট। ধারণা করা হয় তিনি ত্রয়োদশ শতাব্দীতে বিদ্যামান ছিলেন।

চণ্ডী মঙ্গল কাব্যের বই

মঙ্গলকাব্যের এই ধারায় রচিত হয়েছে কালকেতু ও ধনপতি উপাখ্যান। চণ্ডীমঙ্গলের আদি কবি ছিলেন চতুর্দশ শতকের মাণিক দত্ত। এই ধারার অন্যান্য কবিরা ছিলেন মাধবাচার্য, মুকুন্দরাম চক্রবর্তী, মুক্তারাম সেন, দ্বিজ হরিরাম, ভাবানী শঙ্কর, জগদীশ প্রমুখ।

মঙ্গলকাব্য (বিদ্যাসুন্দর উপখ্যান):

মঙ্গলকাব্যের এই ধারার কাহিনী সংস্কৃত কাব্য থেকে গৃহীত হয়েছিল। বিহলণ প্রণীত সংস্কৃত ভাষার কাব্য ‘চৌর্যপঞ্চাশিকা’-য় এই আখ্যান রয়েছে। দীনেশচন্দ্রের মতে এইকাব্যের আদি রচয়িতা কবিকঙ্ক ছিলেন ময়মনসিংহ অঞ্চলের। অন্যদিকে দেখা যায় বাংলার সুলতান ফিরোজ শাহের আদেশে দ্বিজ শ্রীধর বিদ্যাসুন্দর রচনা করেছিলেন ১৫৩২ খ্রিষ্টাব্দের দিকে। এই বিচারে দ্বিজ শ্রীধরকে বিদ্যাসুন্দরের আদি কবি বলা যায়। এরপর অন্যান্য যাঁরা এই কাব্য রচনা করেছিলেন, তাঁরা হলেন- গোবিন্দদাস, কৃষ্ণরাম দাস, কবিশেখর বলরাম, চক্রবর্তী, ভারতচন্দ্র রায় গুনাকর, রামপ্রসাদ সেন, প্রাণরাম চক্রবর্তী, নিধিরাম আচার্য কবিরত্ন, কবীন্দ্র মধুসূদন, ক্ষেমানন্দ, বিশ্বেশ্বর দাস প্রমুখ।

এঁদের ভিতর কবিকঙ্ক জনৈক মুসলমান পীরের আদেশে এই কাব্য রচনা করেছিলেন। ধারণা করা হয় কবিকঙ্ক সত্যপীরে বন্দনা করেছিলেন উক্ত পীরের স্থানে। মুসলমান কবিদের মধ্যে সাবিরিদ খান একটি বিদ্যাসুন্দর রচনা করেছিলেন।

মঙ্গলকাব্য (মনসা মঙ্গল):

মঙ্গলকাব্যের এই ধারায় প্রায় শতাধিক কবি কাব্য রচনা করেন। বেহুলা-লক্ষীন্দরের কাহিনী অবলম্বনে এই কাব্যের সূচনা ঘটেছিল কবি কানা হরিদত্ত। এরপর মনসা মঙ্গল রচনা করেন বিপ্রদাস, নারায়ণ দেব, দ্বিজ বংশীদাস, ষষ্ঠীবর, ক্ষেমানন্দ সেন, কেতকা দাস, গঙ্গাদাস, সেন, ষষ্ঠীবর দত্ত, রামজীবন বিদ্যাভূষণ, জানকীনাথ, বৈদ্যনাথ জগন্নাথ, রাজা রাজসিংহ, গোপালচন্দ্র মজুমদার।

মনসামঙ্গলের বাইরে মুসলমান কবিরা রচনা করেছিলেন সত্যপীরের আখ্যান। তবে এই আখ্যান রচনায় বেশ কিছু হিন্দু কবির নাম পাওয়া যায়। এই ধারার উল্লেখযোগ্ কবিরা ছিলেন- শেখ ফয়জুল্লাহ, গরীবুল্লাহ শাহ, আরিফ, রাজেশ্বের ভট্টাচার্য, ফকীর রাম, দাস, অযোধ্যারাম দাস, কবিচন্দ্র প্রমুখ। মুসলমান কবিরা ধর্মীয় বোধে কিছু সত্যাসত্য নির্ভর কাব্য রচনা করেছিলেন। এর ভিতরে ছিল, আমীর হামজা, হানিফার লাড়াই, আবু শামা ইত্যাদি।

এই সকল কাব্যের কাহিনীগত বিষয় যাই থাক, বাংলা ভাষার ক্রবিবর্তনের ধারায় একটি নবতর বিষয় যুক্ত হয়েছিল। মুসলমানদের বাংলায় আসার আগে, বাংলা ভাষায় ছিল তৎসম, অর্ধ-তৎসম, তদ্ভব, অস্ট্রিক (মুণ্ডারি, সাঁওতালি), দ্রাবিড় শব্দ। মুসলমনাদের সূত্রে বাংলা ভাষায় আরবি, ফারসি, তুর্কি ইত্যাদি ভাষার প্রচুর শব্দ প্রবেশ করেছিল। কালক্রমে এই শব্দগুলো বাংলা ভাষার শব্দ ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে। ইসলাম ধর্মের সাথে সম্পর্কিত নামাজ, রোজা, জাকত-এর মতো শব্দ ছাড়াও কলম, আদালত, আইন ইত্যাদি বৈষয়িক শব্দও বাংলাতে প্রবেশ করেছিল। এর প্রভাব দেখা যায় এই সময়ের কাব্যগুলোতে।

ভারতবর্ষে ইংরেজ শাসনের পূর্বকাল পর্যন্ত, পরতুগিজ এবং বার্মিজ শব্দ দু একটি প্রবেশ করেছে। ফরাসীদের সাথে বাণিজ্যের সূত্রে কিছু ফরাসি শব্দও বাংলাতে প্রবেশ করেছিল। কিন্তু ইউরোপের ভাষাগুলোর ভিতরে ইংরেজি শব্দ সব চেয়ে বেশি প্রবেশ করেছে। এবং এখনও তা অব্যাহত আছে। অন্যান্য জাপানি, চীনা, জার্মানি, রুশ ইত্যাদি শব্দও ঢুকেছে ইংরেজদের সূত্রেই।

বাংলা বর্ণমালা ——–

প্রাচীন কাল থেকে পাঁচটি স্তর পার হয়ে আধুনিক বর্ণমালা এসেছে। তখন কোন বর্ণমালা ছিলো না, গাছপালা-মানুষ-প্রাণী’র ছবি এঁকে মনের ভাব প্রকাশ করা হতো। এটা হচ্ছে বর্ণমালার প্রথম স্তর – “গ্রন্থিলিপি”। আনুমানিক দশ-বারো হাজার বছর আগে মানুষ গ্রন্থিলিপি দ্বারা মনের ভাব প্রকাশ করতো। এরপর এলো “ভাবলিপি” – সম্পুর্ন ছবি না এঁকে সংকেত বা চিহ্ন বা প্রতীকের মাধ্যমে মনের ভাব প্রকাশ করার মাধ্যম। ভাবলিপি ছিলো অনেকটা এমনঃ দিন বোঝাতে পূর্ন বৃত্ত, অর্থাৎ সূর্য আঁকা হতো, আর রাত বোঝাতে অর্ধ বৃত্তের সাথে তাঁরা আঁকা হতো। এরপর এলো তৃতীয় স্তর – “শব্দলিপি”, এই স্তরে ব্যাপক হারে ছবি’র বদলে চিহ্নের ব্যবহার হতে লাগলো। শব্দলিপি আরো সংক্ষিপ্ত হয়ে এলো চতুর্থস্তর – “অক্ষরলিপি”। অক্ষরলিপি আরো সংক্ষিপ্ত হয়ে পঞ্চম স্তর হিশেবে এলো “ধ্বনিলিপি”।

এই ধ্বনিলিপি থেকেই আধুনিক বর্ণমালার উৎপত্তি। সেইসময় বিভিন্ন বর্ণে বা রঙে বিভিন্ন অক্ষর লিখা হতো, সেখান থেকেই অক্ষরের নাম হয়েছে বর্ণ, বর্ণমালা। আমাদের বাঙলা বর্ণমালা এসেছে প্রাচীন ভারতীয় “ব্রাহ্মীলিপি” থেকে। পৌরাণিক উপকথামতে হিন্দু দেবতা ব্রহ্মা ভারতবর্ষের প্রাচীন লিপি আবিষ্কার করেছিলেন এবং ধ্বনির সাথে মানুষকে এই লিপি দান করেছিলেন, তার নামানুসারে ঐ লিপির নাম হয় ব্রাহ্মীলিপি। কেউ কেউ বলেন, বৈদিক যুগে ব্রাহ্মণরা ছিলেন শ্রেষ্ঠ পুরোহিত। ব্রাহ্মণদের দ্বারা এই লিপি আবিষ্কৃত হয়েছিল বলেই এর নাম ব্রাহ্মীলিপি।

যে যাই বলুক, ভারতবাসী নিজেরাই সৃষ্টি করেছিলেন ব্রাহ্মীলিপি। ব্রাহ্মীলিপির পেছনে ফিনিশীয় লিপির প্রভাব আছে বলে দাবী করা হয়। তবে প্রাচীন ভারতীয়রা সম্ভবত স্বাধীনভাবেই নিজেদের লিপি উদ্ভাবন করেছিল – কারণ ফিনিশীয় লিপির চেয়ে ব্রাহ্মীলিপির পার্থক্য অনেক। খ্রিস্টপূর্ব ৫ম শতক থেকে ৩৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ভারতে ব্রাহ্মীলিপি প্রচলিত ছিল। এরপর “অশোক লিপি” বা “মৌর্য লিপি” তে এর বিবর্তন শুরু হয়। এর পরের ধাপে আসে “কুষাণ লিপি”, এগুলি কুষাণ রাজাদের আমলে প্রচলিত ছিল। এরপর ব্রাহ্মীলিপিটি উত্তরী ও দক্ষিণী – এই দুইভাগে ভাগ হয়ে যায়। উত্তরী লিপিগুলির মধ্যে পূর্বদেশীয় গুপ্তলিপি প্রধান, এটি ৪র্থ ও ৫ম শতাব্দীতে প্রচলিত ছিল। গুপ্তলিপি থেকে আবির্ভাব হয় “কুটিল লিপির”, এটি ৬ষ্ঠ থেকে ৯ম শতক পর্যন্ত প্রচলিত ছিল। কুটিল লিপি থেকে উদ্ভব হয় নাগরী লিপির। প্রাচীন নাগরী লিপির পূর্ব শাখা থেকে ১০ম শতকের শেষভাগে এসে উৎপত্তি হয়েছে বাঙলা লিপির।

ব্রাহ্মলিপি

অর্থাৎ ব্রাহ্মীলিপি > অশোক লিপি বা মৌর্য লিপি > কুশাণ লিপি > উত্তরী গুপ্তলিপি (পূর্বদেশীয়) > কুটিল লিপি > নাগরী লিপি > বাঙলা লিপি। ব্রাহ্মীলিপি থেকে সৃষ্ট বাঙলা বর্ণমালা দেখতে কিন্তু এখনকার বর্ণমালার মতোন ছিলো না, সময়ের পরিবর্তনে বর্ণ’র চেহারারও পরিবর্তন হয়েছে। আগে তো ছাপাখানা ছিলো না, শুদ্ধতা বজায় থাকবে কী করে? তখন মানুষ হাতে কাব্য লিখতো, পুঁথি লিখতো। একেকজনের হাতের লেখা একেকরকম, দশজন দশরকম করে “ক” “খ” লিখেছে। এভাবেই পরিবর্তিত হতে হতে পাল্টে গেছে বাঙলা বর্ণমালা। কম্বোজের রাজা নয়পালদেবের ইর্দার দানপত্রে এবং প্রথম মহীপালের বাণগড়ের দানপত্রে সর্বপ্রথম আদি বাংলা বর্ণমালা দেখতে পাওয়া যায়।

ব্রাহ্মীলিপি’র প্রথম পাঠোদ্ধার করেন প্রাচ্যবিদ্যা-বিশারদ প্রিন্সসেপ। আমাদের দেশের সিলেট’র উপভাষারও কিন্তু বর্ণমালা ছিলো, আধুনিক বাঙলা বর্ণমালা থেকে একটু আলাদা, প্রায় অবিকৃত নাগরীলিপি’র মতো। এখন পর্যন্ত তিন ধরণের ব্রাহ্মীলিপির নমুনা আবিষ্কৃত হয়েছে, যাতে ৪৪টি বর্ণ পাওয়া যায়। এরমধ্যে স্বরবর্ণ ৯টি, ব্যাঞ্জনবর্ণ ৩৫টি। বাঙলা বর্ণমালার “ঔ” ও “ঋ” ব্রাহ্মীলিপির স্বরবর্ণে না পাওয়া গেলেও ব্যাঞ্জনবর্ণে এ দুটি বর্ণের নমুনা পাওয়া গেছে। আমরা এখন যে কয়টি স্বরবর্ণ-ব্যঞ্জনবর্ণ দেখি, আগে এরচে কয়েকটি বেশি ছিলো। এই তো কিছুদিন আগেও স্বরবর্ণতে ৯ ছিলো, এখন আর ৯’র অস্তিত্ব নেই। এর সাথে ছিলো ৠ।

ব্যঞ্জনবর্ণতে ছিলো ল (মূর্ধন্য ল), ছিলো হ্ল (মহাপ্রাণ ল), ছিলো ব (অন্তঃস্থ ব)। যুগে যুগে বাঙলা বর্ণমালার আকার-আকৃতি বদলাতে বদলাতে ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে মোটামুটি স্থির রুপ পায়, মুদ্রণযন্ত্রের ঢালাই ধাতুতে তৈরি বর্ণের কল্যাণে। তবে সেগুলো কিন্তু বাঙলা ভাষা-ভাষীরা করেননি, সেগুলো করেছিলো ইউরোপীয়রা। এর আগে, ১৬৬৭ খ্রিস্টাব্দে আমস্টারডাম থেকে প্রকাশিত “চায়না ইলাস্ট্রেটা” নামক বইয়ে বাঙলা বর্ণমালা’র নমুনা ছাপা হয়েছিলো। ১৬৬৭ সালের পর আরো একটি বইয়ে বাঙলা বর্ণমালা’র নমুনা ছাপা হয়, ১৭৪৩ সালে লাইডেন থেকে প্রকাশিত “ডিসারতিও সিলেকটা” নামের বইয়ে। এই নমুনা বর্ণগুলো ব্লকের তৈরী হরফে ছাপা হয়েছিলো। ১৭৭৮ সালে ন্যাথলিয়েন ব্র্যাসি হ্যালহেড হুগলী থেকে বাঙলা ভাষার প্রথম ব্যাকরণ প্রকাশ করেন – “এ গ্রামার অফ দ্যা বেঙ্গল ল্যাঙ্গুয়েজ”।

গ্রামার অফ দ্যা বেঙ্গল ল্যাঙ্গুয়েজ

বইটি রোমান হরফে লিখলেও উদাহারণগুলো ছেপেছিলেন বাঙলা বর্ণমালায়। আগে ছাপা হয়েছিলো ব্লকে, এবার ছাপা হয় ধাতব কী-তে। প্রতিটা বর্ণের জন্য আলাদা আলাদা ধাতব কী। হ্যালহেডকে এই কাজে সহায়তা করেন পঞ্চানন কর্মকার। বর্ণগুলো দেখতে ছিলো আকারে বড়ো, এখনকার বর্ণের চেয়ে একটু আলাদা, তবে অত্যন্ত সুশ্রী ও সাজানো -গোছানো। পঞ্চাননকর্মকার ও হ্যালহেড স্থির করে দিয়ে গেলেন বাঙলা বর্ণমালার রূপ। এরপর মুদ্রণযন্ত্রের প্রয়োজনে ও উৎসাহে আরো সুশ্রী হয়েছে বাঙলা বর্ণমালা। তৈরি হয়েছে মনো ও লাইনো রুপসী অক্ষর। তৈরি হয়েছে কয়েকটি নতুন অক্ষর, যুক্তাক্ষর পাল্টেছে মনো ও লাইনো টাইপের কল্যাণে।

সংস্কৃত না পালি—ভারতের সবচেয়ে পুরোনো ভাষা কোনটি তা নিয়ে সুদীর্ঘকাল ধরেই বিতর্ক চলেছে। তবে সে বিতর্ককে পাশ কাটিয়েও বলা যায়, সংস্কৃত গ্রিকের চেয়ে বেশি নিখুঁত, ল্যাটিনের চেয়ে বেশি গভীর, এবং এ দুটো ভাষার তুলনায় অনেক বেশি নিপুণতার সাথে সংস্কারকৃত, যদিও তাদের উভয়ের সাথেই সংস্কৃতের যথেষ্ট পরিমাণে সাদৃশ্য রয়েছে। ক্রিয়াপদের মূল এবং ব্যাকরণগত গঠনপ্রণালীর দিক থেকে এ তিনটি ভাষায় এত বেশি মিল যে, ভাষাগুলোর উৎপত্তি যে একই উৎসমূল থেকে হয়েছে সে বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশই নেই। সেই অজ্ঞাত মূল সূত্রটি অবশ্য চিরতরে কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_img

Related articles

Prepositional Phrase কাকে বলে? চেনার উপায়।

যে Phrase বা শব্দ সমষ্টি Preposition এর কাজ করে তাকে Prepositional Phrase বলে। Preposition মূলত: Noun / Noun equivalent...

Gerund কাকে বলে? চেনার উপায় এবং এর ব্যবহার।

বাক্যে যে Verb এর শেষে ing যুক্ত হয়ে যে Verb একই সাথে Verb ও Noun-এর কাজ করে থাকে...

৪৬তম বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষা ০৯ মার্চ

8৬তম বি.সি.এস পরীক্ষা-২০২৩ এর প্রিলিমিনারি টেস্ট (MCQ Type) যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণপূর্বক আগামী ০৯ মার্চ ২০২৪ তারিখ, শনিবার সকাল...

বিসিএস পরীক্ষায় সাধারণ জ্ঞানে অসাধারণ হওয়ার কৌশল

বিসিএস পরীক্ষায় সাধারণ জ্ঞান কারও কাছে আগ্রহের বিষয়, কারও-বা ভয়ের কারণ। আগ্রহ বা ভয় যেটাই থাক না কেন...