বাংলা সাহিত্য: কালবিচারে বাংলা সাহিত্যকে তিনটি প্রধান যুগে ভাগে ভাগ করা যায়: প্রাচীন যুগ (৬৫০-১২০০), মধ্যযুগ (১২০০-১৮০০) ও আধুনিক যুগ (১৮০০-)। মধ্যযুগ আবার তিনভাগে বিভক্ত: আদি-মধ্যযুগ (১২০০-১৩৫০), মধ্য-মধ্যযুগ (১৩৫০-১৭০০) ও অন্ত্য-মধ্যযুগ (১৭০০-১৮০০)। অনুরূপভাবে আধুনিক যুগও কয়েকটি ভাগে বিভক্ত: প্রস্ত্ততিপর্ব (১৮০০-১৮৬০), বিকাশের যুগ (১৮৬০-১৯০০), রবীন্দ্রপর্ব (১৯০০-১৯৩০), রবীন্দ্রোত্তর পর্ব (১৯৩০-১৯৪৭) এবং বাংলাদেশ পর্ব (১৯৪৭-)।
প্রাচীন যুগ খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকে বঙ্গদেশ মৌর্যাধিকারে আসার পর থেকে আর্যভাষা এদেশে প্রভাব বিস্তার করতে থাকে এবং এর প্রায় সহস্রাব্দ পরে প্রাকৃত ভাষা থেকে বাংলা ভাষার উৎপত্তি হয়। মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী (১৮৫৩-১৯৩১) কর্তৃক ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে আবিষ্কৃত বাংলা ভাষার প্রাচীনতম নিদর্শন চর্যাপদের পদগুলির রচনাকাল আনুমানিক খ্রিস্টীয় সপ্তম থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত। এতে বৌদ্ধ সহজিয়াদের ধর্মতত্ত্ব ও সাধন-ভজনমূলক ৪৭টি পদ আছে এবং সেগুলি সুনির্ধারিত তাল, রাগ ও সুরে গীত হওয়ার উপযোগী। পদগুলির ভাব ও ভাষা সর্বত্র সহজবোধ্য নয়; কতক বোঝা যায় কতক বোঝা যায় না, তাই এ ভাষার নাম হয়েছে সন্ধ্যা ভাষা। ব্যঞ্জনাময় শব্দ-ব্যবহার, উপমা-রূপকাদি অলঙ্কারের প্রয়োগ, প্রাকৃতিক বর্ণনা, সমাজচিত্র ইত্যাদি বিবেচনায় পদগুলির সাহিত্যিক ও ভাষানিদর্শনগত মূল্য অপরিসীম। পদগুলির পদকর্তাগণ ‘সিদ্ধাচার্য’ নামে খ্যাত এবং তাঁদের কয়েকজন হলেন লুইপা, ভুসুকুপা, কাহ্নপা, শবরপা প্রমুখ।
চর্যাপদের পরে প্রবাদ, বচন, ছড়া, ডাক ও খনার বচন ইত্যাদি কিছু কিছু কাব্যনিদর্শন থাকলেও চতুর্দশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য কোনো রচনা পাওয়া যায় না। তাই এ সময়টাকে (১২০১-১৩৫০) কেউ কেউ ‘অন্ধকার যুগ’ বলে অভিহিত করেন। প্রকৃতপক্ষে এটা ছিল পরিবর্তনের যুগ; ইসলাম ও ইসলামি সংস্কৃতির সংস্পর্শে এবং মুসলিম শাসকদের ভিন্নতর রাষ্ট্রীয় ও সমাজব্যবস্থা প্রবর্তনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে তখন এক নতুন পরিবেশ ও সংস্কৃতির বিকাশ ঘটছিল। সে সময় বাংলা ভাষা ও সাহিত্য ছিল সৃজ্যমান অবস্থায় এবং চর্যার বঙ্গীয়-বৈশিষ্ট্যময় অপভ্রংশ ভাষা আরও বেশি মাত্রায় বাংলা হয়ে ওঠে। এ যুগের প্রাপ্ত নিদর্শনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ১৩শ-১৪শ শতকের রামাই পন্ডিতের গাথাজাতীয় রচনা শূন্যপুরাণ। এতে বৌদ্ধদের ওপর বৈদিক ব্রাহ্মণদের অত্যাচার, মুসলমানদের জাজপুর প্রবেশ ইত্যাদি ঘটনার বর্ণনাসম্বলিত ‘নিরঞ্জনের রুষ্মা’ শীর্ষক একটি কবিতা আছে। এছাড়া আছে অপভ্রংশ ভাষায় রচিত প্রাকৃতপৈঙ্গল নামক একটি গীতিকবিতার সংকলন, যার ছন্দ ও ভাষা প্রাকৃত বা আদি পর্যায়ের বাংলা। হলায়ুধ মিশ্র রচিত সেখশুভোদয়া (আনু. ১২০৩) নামক সংস্কৃত গ্রন্থেও একটি বাংলা গান পাওয়া গেছে। এরূপ পীরমাহাত্ম্যসূচক ছড়া বা আর্যা, প্রেমসঙ্গীত এবং খনার বচন শ্রেণির দু-একটি বাংলা শ্লোকই এ সময়কার প্রধান রচনা।
মধ্যযুগ আদি-মধ্যযুগ সাধারণভাবে খ্রিস্টীয় ১৩শ-১৪শ শতক পর্যন্ত কাল বাংলা সাহিত্যের আদি-মধ্যযুগ বা চৈতন্যপূর্ব যুগ বলে চিহ্নিত। এ সময়ের বাংলা সাহিত্য তিনটি প্রধান ধারায় বিকশিত হয়েছে: বৈষ্ণব সাহিত্য, মঙ্গল সাহিত্য এবং অনুবাদ সাহিত্য। বড়ু চন্ডীদাস (১৪শ শতক) এ সময়ের প্রথম উল্লেখযোগ্য কবি, যিনি রাধাকৃষ্ণের প্রণয়বিষয়ক নাটগীতিকাব্য রচনা করেন। তাঁর আগে কবি জয়দেব সংস্কৃত ভাষায় রাধা-কৃষ্ণের প্রেমমূলক যে গীতিসাহিত্যের প্রবর্তন করেন, চন্ডীদাস সেই ধারাকেই বিকশিত করে তোলেন।
চৈতন্যদেবের আগে-পরে রচিত সহস্রাধিক বৈষ্ণব পদের ভণিতায় একাধিক চন্ডীদাসের নাম পাওয়া যায় আদি চন্ডীদাস, কবি চন্ডীদাস, দ্বিজ চন্ডীদাস ও দীন চন্ডীদাস। এঁরা এক না পরস্পর ভিন্ন তা নিয়ে বাংলা সাহিত্যে বিতর্ক আছে, যা ‘চন্ডীদাস সমস্যা’ নামে পরিচিত। ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে বসন্তরঞ্জন রায় বিদ্বদ্বল্লভের সম্পাদনায় বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন নামে যে পুথিটি প্রকাশিত হয়, তার ভণিতায় বড়ু চন্ডীদাসের নাম পাওয়া যায়। সম্ভবত ইনিই আদি চন্ডীদাস, যাঁর কাব্যের রচনাকাল ১৩৫০ খ্রিস্টাব্দ বলে ধরা যায়। মালাধর বসু সংস্কৃত শ্রীমদ্ভাগবত অবলম্বনে পয়ার ছন্দে কৃষ্ণলীলা বিষয়ক উপাখ্যান শ্রীকৃষ্ণবিজয় রচনা করেন ১৪৮০ খ্রিস্টাব্দের দিকে। এই কাব্যের জন্য গৌড়েশ্বর তাঁকে ‘গুণরাজ খাঁ’ উপাধিতে ভূষিত করেন। এটি ‘মঙ্গল’ বা ‘বিজয়’ জাতীয় পাঁচালি বা আখ্যানকাব্য হিসেবে পরিচিত; তাই এর অন্য নাম গোবিন্দমঙ্গল বা গোবিন্দবিজয়। এই পাঁচালিকাব্য বাংলার অনুবাদ শাখারও একটি প্রাচীনতম নিদর্শন বলে অনেকে মনে করেন।
এ যুগেই রামায়ণ, মহাভারত, ভাগবত প্রভৃতি অনুবাদকাব্যের রচনা শুরু হয়। এ ব্যাপারে মুসলমান শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এ সময় বাংলা সাহিত্যের বিকাশে সুলতান আলাউদ্দীন হুসেন শাহ, তাঁর পুত্র নসরৎ শাহ (১৫১৯-৩২) এবং সেনাপতি পরাগল খাঁর উৎসাহ ও অবদান বিশেষভাবে স্মরণীয়। ব্রজবুলি ভাষায় বাঙালিদের পদ-রচনার শুরুও এ সময়েই। এ সময় কবি কঙ্ক সত্যপীরের মহিমা প্রচারের উদ্দেশ্যে বাংলায় সর্বপ্রথম বিদ্যাসুন্দর কাহিনী রচনা করেন (আনু. ১৫০২)। চৈতন্যদেবের (১৪৮৬-১৫৩৩) আবির্ভাবও এ সময়। তিনি স্বপ্রতিষ্ঠিত গৌড়ীয় বৈষ্ণবমত বাংলা ভাষায় প্রচার করলে বাংলা সাহিত্যের নতুন দিক উন্মোচিত হয় এবং বৈষ্ণব সাহিত্যেরও ভিত্তি স্থাপিত হয়।
মধ্য-মধ্যযুগ এ সময় চৈতন্যদেব বঙ্গদেশে এক নবভক্তি-ধারার প্রবর্তন করেন, যা ভাবচৈতন্যের ক্ষেত্রে রেনেসাঁর সূচনা করে। তাঁর আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের কারণে বাংলায় একটি শক্তিশালী সাহিত্যিকগোষ্ঠী এবং এক বিরাট সাহিত্যধারার সৃষ্টি হয়। এ যুগেই বাংলায় জীবনচরিত লেখার প্রচলন হয় এবং প্রধানত চৈতন্যদেবের জীবনকে কেন্দ্র করে জীবনীগ্রন্থগুলি রচিত হয়। এ ধরনের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হলো: বৃন্দাবনদাসের চৈতন্যভাগবত (১৫৭৩), জয়ানন্দের চৈতন্যমঙ্গল (১৬শ শতকের শেষভাগ), লোচনদাসের (১৫২৩-১৫৮৯) চৈতন্যমঙ্গল এবং কৃষ্ণদাস কবিরাজের চৈতন্যচরিতামৃত (১৬১৫)। এগুলি ছাড়া আরও কিছু উল্লেখ করার মতো চৈতন্য-সংশ্লিষ্ট জীবনীকাব্য হচ্ছে নরহরি চক্রবর্তীর ভক্তিরত্নাকর (চৈতন্যদেবের পার্ষদ-ভক্তদের জীবনী), নিত্যানন্দ দাসের প্রেমবিলাস (শ্রীনিবাস, নরোত্তম ও শ্যামানন্দের জীবনী এবং তাঁদের ধর্মমত প্রচারের কথা) ও ঈশান নাগরের অদ্বৈতপ্রকাশ (১৫৬৮-৬৯)। এগুলির মধ্যে চৈতন্যচরিতামৃতকে চৈতন্যদেবের সর্বশ্রেষ্ঠ জীবনীগ্রন্থ মনে করা হয়। পান্ডিত্যপূর্ণ এ গ্রন্থে একাধারে জীবনচরিত, দার্শনিক তত্ত্ব ও ভক্তিতত্ত্ব চমৎকারভাবে বিবৃত হয়েছে। জয়ানন্দের চৈতন্যমঙ্গল বেশকিছু ঐতিহাসিক তথ্যসমৃদ্ধ।
পদাবলি এ সময়ের একটি উল্লেখযোগ্য সাহিত্যধারা হচ্ছে পদাবলি। এর শুরু চৈতন্যপূর্বযুগেই। রাধাকৃষ্ণের লীলাবিষয়ক এ সাহিত্য ভাব, ভাষা ও ছন্দে অতুলনীয়। এতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আত্মার আত্মীয়রূপে কল্পিত; তাঁর ও ভক্তের মধ্যে কোনো দূরত্ব নেই। পরে রাধাকৃষ্ণের প্রণয়লীলা এবং চৈতন্যদেবের প্রেমসাধনাকে অবলম্বন করেই বিস্তার লাভ করে মধ্যযুগের পদাবলি বা গীতিকাব্যের ধারা। চৈতন্যদেবের পরবর্তী বৈষ্ণব কবিদের দ্বারা পদাবলি সাহিত্য বিশেষভাবে পরিপুষ্ট হয়। অনেকের মতে বাংলা সাহিত্যের প্রকৃত জাগরণ ঘটে এই পদাবলি রচনার মধ্য দিয়েই। কতিপয় মুসলমানসহ অগণিত কবি রাধাকৃষ্ণলীলার পদ রচনা করে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেন, যেমন: চন্ডীদাস, জ্ঞানদাস, লোচনদাস, গোবিন্দদাস, কবিবল্লভ রায়শেখর, বলরাম দাস, নরোত্তম দাস, নরহরি দাস, রাধামোহন ঠাকুর প্রমুখ। মিথিলার বিদ্যাপতি ছিলেন চৈতন্যপূর্ব কবি। মৈথিল ভাষায় রচিত তাঁর পদগুলি পদাবলি সাহিত্যের মূল্যবান সম্পদ। চন্ডীদাস ও বিদ্যাপতি পদাবলি সাহিত্যের দুই সেরা কবি।
অনুবাদ সাহিত্য এ ক্ষেত্রে প্রথমেই উল্লেখযোগ্য রামায়ণ রচয়িতা কৃত্তিবাস ওঝা। বড়ু চন্ডীদাসের পরে তিনিই বাংলা সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য কবি। তাঁর রচিত রামায়ণ বাংলা ভাষায় প্রথম ও সর্বাধিক জনপ্রিয় কাব্য। বর্ণনার হূদয়গ্রাহিতা এবং ভাষার প্রাঞ্জলতাই এর জনপ্রিয়তার কারণ। কৃত্তিবাস ১৫শ শতকের গোড়ার দিকে জীবিত ছিলেন। তাঁর কাব্যে মধ্যযুগের বাঙালি-জীবন প্রত্যক্ষ হয়ে উঠেছে। ১৮০২-৩ খ্রিস্টাব্দে গ্রন্থটি শ্রীরামপুর মিশন থেকে মুদ্রিত হয়। মুদ্রণের সঙ্গে সঙ্গে তা সমগ্র বঙ্গদেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করে। কৃত্তিবাসের পরে আরও অনেকে রামায়ণ রচনা করেছেন। সতেরো শতকে ময়মনসিংহের মনসামঙ্গলের কবি দ্বিজ বংশীদাসের কন্যা চন্দ্রাবতীর রামায়ণগাথা সে অঞ্চলে প্রচলিত ছিল। উত্তরবঙ্গের অদ্ভুত আচার্য রামায়ণ গায়ক হিসেবে খ্যাত ছিলেন। নোয়াখালীর দ্বিজ ভবানী দাসের শ্রীরামপাঁচালি কাব্য অধ্যাত্ম্যরামায়ণ অবলম্বনে রচিত।
মহাভারতের প্রথম বাংলা অনুবাদ হচ্ছে কবীন্দ্র মহাভারত। ১৫১৫-১৯ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে কবীন্দ্র পরমেশ্বর এটি রচনা করেন। লস্কর পরাগল খাঁর নির্দেশে রচিত বলে এটি পরাগলী মহাভারত নামেও পরিচিত। কবীন্দ্র মহাভারতে অশ্বমেধপর্ব সংক্ষিপ্ত ছিল বলে ছুটি খাঁর নির্দেশে শ্রীকর নন্দী জৈমিনিসংহিতার অশ্বমেধপর্ব অবলম্বনে বিস্তৃত আকারে সেটি রচনা করেন, যাকে পৃথক গ্রন্থ না বলে বরং কবীন্দ্র মহাভারতের পরিশিষ্ট বলা চলে। বাংলা মহাভারতের প্রধান কবি কাশীরাম দাস আনুমানিক ১৬০২-১০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে তাঁর কাব্য রচনা করেন। শ্রীরামপুর প্রেস থেকে ১৮০১-৩ খ্রিস্টাব্দে কাব্যটি মুদ্রিত হয়। সকল বাংলা মহাভারতের মধ্যে এটি সর্বাধিক জনপ্রিয়তা লাভ করে।
মঙ্গলকাব্য বাংলার নিজস্ব উপাদানে রচিত লৌকিক দেবমাহাত্ম্যমূলক কাহিনীকাব্য। পাঁচালি কিংবা পালার আকারে চৈতন্যপূর্ব যুগেই এগুলি রচিত হয়। এগুলির নাম কেন মঙ্গলকাব্য হয়েছে সে সম্পর্কে মতভেদ আছে। এর পালা এক মঙ্গলবারে শুরু হয়ে আরেক মঙ্গলবারে শেষ হতো বলে কেউ কেউ একে মঙ্গলকাব্য বলেছেন। নামকরণের ক্ষেত্রে এরূপ একটি কারণকে বিবেচনা করা হলেও মূলত কাব্যগাথার মাধ্যমে দেবদেবীর মাহাত্ম্য প্রচার এবং তা শ্রবণে ধর্মীয় বিনোদনের সঙ্গে মঙ্গল কামনাই বাঙালি হিন্দু কবিকে মঙ্গলকাব্য রচনায় উৎসাহিত করে। প্রাকৃতিক প্রতিকূলতায় পূর্ণ বঙ্গদেশে তাই অবশ্যম্ভাবিরূপে এসেছে পুরাণের দেবদেবীরা এবং ভক্তমনের কল্পনাপ্রবাহে অসংখ্য মানব ও অতিমানব; আর চরিত্রগুলিও হয়ে উঠেছে শাশ্বত বাংলার প্রকৃতির সঙ্গে মিশে যাওয়া সংগ্রামী মানুষের প্রতীক। এই কাব্যগুলি থেকে বাংলাদেশের তৎকালীন ধর্ম, রাষ্ট্র, সমাজ, কৃষি, বাণিজ্য, অর্থনীতি প্রভৃতি সম্বন্ধে অনেক তথ্য জানা যায়।
মঙ্গলকাব্যগুলির মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন মনসামঙ্গল, তন্মধ্যে বিজয়গুপ্তের পদ্মাপুরাণ (১৪৯৪) সর্বাধিক জনপ্রিয়। মনসামঙ্গল এক সময় পূর্ববঙ্গের জাতীয় কাব্যের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত ছিল। মঙ্গলকাব্যের ইতিহাসে চন্ডীমঙ্গল কাব্যধারা উৎকর্ষের জন্য বিখ্যাত। মুকুন্দরাম চক্রবর্তী (১৬শ শতক) রচিত চন্ডীমঙ্গল সর্বাপেক্ষা বিখ্যাত; এর জন্য রাজা রঘুনাথ রায় তাঁকে ‘কবিকঙ্কণ’ উপাধিতে ভূষিত করেন। অন্যান্য মঙ্গলকাব্য হচ্ছে ধর্মমঙ্গল, শিবমঙ্গল ইত্যাদি এবং এগুলির প্রধান রচয়িতারা ছিলেন ১৮শ শতকের। ধর্মমঙ্গলের আদি কবি ময়ূরভট্ট; তাঁর পরবর্তী প্রসিদ্ধ কবি ছিলেন খেলারাম চক্রবর্তী, যাঁর কাব্যের নাম গৌড়কাব্য; কিন্তু এঁদের কাব্যের পুথি পাওয়া যায়নি; একমাত্র রূপরাম চক্রবর্তীর কাব্যই পাওয়া গেছে, যার রচনাকাল ১৬৪৯-৫৯ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বলে ধরা হয়। রূপরাম বাস্তব দৃষ্টিতে মানব-জীবন বর্ণনা করেছেন।
কৃষিভিত্তিক সমাজজীবনে বৈদিক দেবতা রুদ্র শিবের রূপ ধারণ করে; শিব বাঙালি হিন্দুর জীবনে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, তাই বাঙালির সুখ-দুঃখ ভরা সংসারের কথা স্থান পেয়েছে শিবমঙ্গলে। এ ধারার প্রথম কাব্য দ্বিজ রতিদেবের মৃগলুব্ধ (১৬৭৪) পাওয়া গেছে চট্টগ্রামের পটিয়ায়। শিবায়নের শ্রেষ্ঠ কাহিনীর রচয়িতা রামেশ্বর চক্রবর্তী (১৭১০-১১)। এগুলি ছাড়া শীতলামঙ্গল (কৃষ্ণরাম দাস) ও ষষ্ঠীমঙ্গল নামে দুটি মঙ্গলকাব্যের কথাও জানা যায়। ব্যাঘ্রদেবতা দক্ষিণরায়ের কথা নিয়ে রচিত শেষোক্ত কাব্যটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এ কাব্যে সমাজধর্মের সমন্বয় প্রয়াসে নিম্নশ্রেণীর হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের সহাবস্থানের কথা আছে। ফলে দক্ষিণরায়ের সঙ্গে মুসলমান পীর বড় খাঁ গাজীর পূজাও এতে স্থান পেয়েছে।
মুসলমানদের বাংলা সাহিত্যচর্চা মুসলমানরা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যচর্চায় এগিয়ে আসে সুলতানি আমলে। বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে তাদের বড় অবদান কাহিনীকাব্য বা রোম্যান্টিক কাব্যধারার প্রবর্তন। প্রাচীন ও মধ্যযুগের বৌদ্ধ-হিন্দু রচিত বাংলা সাহিত্যে যেখানে দেবদেবীরা প্রধান এবং মানুষ অপ্রধান সেখানে মুসলমান রচিত সাহিত্যে মানুষ প্রাধান্য পেয়েছে। মুসলমান কবিরা কাহিনীকাব্য ও ধর্মীয় সাহিত্যের পাশাপাশি হিন্দু-মুসলমান সংস্কৃতির সমন্বয়মূলক সাহিত্যও রচনা করেছেন; এমনকি চৌতিশা, জ্যোতিষ ও সঙ্গীতশাস্ত্রীয় কাব্যও তাঁরা রচনা করেছেন। বিষয়বস্ত্তর দিক থেকে মধ্যযুগের মুসলমান রচিত কাব্যগুলিকে প্রধানত ছয়টি ভাগে ভাগ করা যায়: কাহিনীকাব্য, ধর্মীয় কাব্য, সংস্কৃতিবিষয়ক কাব্য, শোকগাথা, জ্যোতিষশাস্ত্রীয় কাব্য এবং সঙ্গীতশাস্ত্রীয় কাব্য।
মুসলমান কবিদের মধ্যে প্রাচীনতম হচ্ছেন শাহ মুহম্মদ সগীর। তাঁর কাব্য ইউসুফ-জুলেখা সুলতান গিয়াসুদ্দীন আজম শাহের রাজত্বকালে (১৩৮৯-১৪১০) রচিত বলে মনে করা হয়। এর সব পুথি চট্টগ্রাম ও ত্রিপুরা (বর্তমান কুমিল্লা ও পার্শবর্তী ভারতীয় ত্রিপুরা) থেকে পাওয়া গেছে। বাইবেল-কুরআনের ইউসুফ নবীর সংক্ষিপ্ত কাহিনী যা ফেরদৌস ও জামীর ইউসুফ-জুলেখায় পল্লবিত, তিনি তা বাংলায় যেভাবে উপস্থাপন করেছেন, তাতে তা একটি মৌলিক কাব্যের মর্যাদা পেয়েছে। জৈনুদ্দীন একটিমাত্র কাব্য রসুলবিজয় রচনা করে খ্যাতি লাভ করেন। তিনি গৌড় সুলতান ইউসুফ শাহের (১৪৭৪-৮১) সভাকবি ছিলেন। এর গল্পাংশ ফারসি থেকে নেওয়া। ‘বিজয়’ জাতীয় যে কাব্যধারা মধ্যযুগে প্রাধান্য লাভ করে তদনুসারেই এর নামের সঙ্গে ‘বিজয়’ শব্দটি যুক্ত হয়। কাহিনীতে কিছু ঐতিহাসিক নামের উল্লেখ থাকলেও ঘটনা ঐতিহাসিক নয়। মুজাম্মিল ১৫শ শতকের মধ্যবর্তী সময়ে বর্তমান ছিলেন। তিনি প্রধানত তিনটি কাব্যের জন্য খ্যাতি অর্জন করেন: নীতিশাস্ত্রবার্তা, সায়াৎনামা ও খঞ্জনচরিত। আরবির অনুবাদ সায়াৎনামায় সুফিবাদ স্থান পেয়েছে এবং অনুবাদে স্বাচ্ছন্দ্যের কারণে কাব্যটি আকর্ষণীয় হয়েছে। তাঁর নীতিশাস্ত্রবার্তায় বহু বিষয় লিপিবদ্ধ হয়েছে। চাঁদ কাজী ছিলেন গৌড় সুলতান হুসেন শাহের (১৪৯৩-১৫১৯) নবদ্বীপের কাজী। তিনি এ পদে থাকাকালেই নবদ্বীপে গৌড়ীয় বৈষ্ণবমতের প্রচার ও প্রসার ঘটে এবং তিনি নানা কারণে বৈষ্ণব-ইতিহাসে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। তিনি কোনো কাব্য রচনা করেননি, তবে বৈষ্ণব পদ রচনা করে খ্যাতি অর্জন করেন। শেখ কবীরও ছিলেন একজন খ্যাতিমান পদকর্তা। তিনি সুলতান নাসিরুদ্দীন নসরৎ শাহের সময়ে আবির্ভূত হন এবং সম্ভবত তাঁর রাজকর্মচারী ছিলেন। আফজাল আলী এযুগের কবিদের অন্যতম। নসিহৎনামা নামে একটি কাব্য এবং বৈষ্ণবীয় ঢঙে রচিত তাঁর কয়েকটি পদ পাওয়া গেছে (সম্ভবত ১৬৬২ খ্রিস্টাব্দের দিকে রচিত)। এ গ্রন্থে কবিত্ব তেমন নেই, তবে সরল ভাষায় ধর্মোপদেশ আছে। সাবিরিদ খান বেশ কয়েকটি গ্রন্থের রচয়িতা বলে মনে করা হলেও কোনোটিরই সম্পূর্ণ অংশ পাওয়া যায়নি। বিদ্যাসুন্দর, রসুলবিজয় এবং হানিফা ও কয়রাপরী নামে তাঁর তিনটি কাব্যের খন্ডিত পুথি পাওয়া গেছে। দোনাগাজীর বিখ্যাত কাব্য সয়ফুলমুলুক বদিউজ্জামাল। তিনি সম্ভবত ১৬শ শতকের মধ্যভাগে আবির্ভূত হন। তাঁর ভাষা সাধারণ এবং প্রাকৃত-প্রভাব ও সারল্যের মিশ্রণে প্রাচীনত্বের দ্যোতক। শেখ ফয়জুল্লাহ মধ্যযুগের মুসলিম কবিদের মধ্যে একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছেন। যে পাঁচটি গ্রন্থের জন্য তিনি খ্যাতিমান সেগুলি: গোরক্ষবিজয়, গাজীবিজয়, সত্যপীর (১৫৭৫), জয়নবের চৌতিশা এবং রাগনামা। রাগনামাকে বাংলা ভাষায় রচিত প্রথম সঙ্গীতবিষয়ক কাব্য মনে করা হয়। দৌলত উজীর বাহরাম খাঁর একটিমাত্র কাব্য পাওয়া গেছে এবং সেটি হলো লায়লী-মজনু; এর রচনাকাল ১৫৬০-৭৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে অনুমান করা হয়। এটি ফারসি কবি জামীর লাইলী-মজনু কাব্যের ভাবানুবাদ; তবে স্বচ্ছন্দ রচনা, কাব্যরস ইত্যাদি গুণে এটি অনন্য। মুহম্মদ কবীর একটিমাত্র কাব্য মধুমালতী রচনা করেই বিখ্যাত হন। ১৫৮৩-৮৭ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে কাব্যটি রচিত বলে মনে করা হয়। কাব্যের পরিবেশ ও পরিকল্পনা গুলে বকাওলী জাতীয়।
এছাড়া অন্যান্য মুসলমান কবির মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন হলেন: সৈয়দ সুলতান (আনু. ১৫৫০-১৬৪৮, কাব্য: নবীবংশ, শব-ই-মিরাজ, রসুলবিজয়, ওফাৎ-ই-রসুল, জয়কুম রাজার লড়াই, ইবলিসনামা, জ্ঞানচৌতিশা, জ্ঞানপ্রদীপ, মারফতি গান, পদাবলি), শেখ পরান (আনু. ১৫৫০-১৬১৫, কাব্য: নূরনামা, নসিহৎনামা), হাজী মুহাম্মদ (আনু. ১৫৫০-১৬২০, কাব্য: নূর জামাল, সুরৎনামা), মীর মুহাম্মদ শফী (আনু. ১৫৫৯-১৬৩০, কাব্য: নূরনামা, নূরকন্দীল, সায়াৎনামা), নসরুল্লাহ্ খাঁ (আনু. ১৫৬০-১৬২৫, কাব্য: জঙ্গনামা, মুসার সওয়াল, শরীয়ৎনামা, হিদায়িতুল ইসলাম), মুহম্মদ খান (আনু. ১৫৮০-১৬৫০, কাব্য: সত্য-কলি-বিবাদ-সংবাদ, হানিফার লড়াই, মকতুল হুসেন), সৈয়দ মর্তুজা (আনু. ১৫৯০-১৬৬২, কাব্য: যোগ-কলন্দর, পদাবলি), শেখ মুত্তালিব (আনু. ১৫৯৫-১৬৬০, কাব্য: কিফায়িতুল-মুসল্লীন), আবদুল হাকীম (আনু. ১৬২০-১৬৯০, কাব্য: লালমতী-সয়ফুল্মুল্ক, নূরনামাসহ ৮টি)। ১৬০০ থেকে ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে উল্লেখযোগ্য আরও কয়েকজন হলেন নওয়াজিশ খাঁ, কমর আলী, মঙ্গল (চাঁদ), আবদুন নবী, মুহম্মদ ফসীহ, ফকির গরীবুল্লাহ্, মুহম্মদ ইয়াকুব, শেখ মনসুর, শেখ চাঁদ, মুহম্মদ উজীর আলী, শেখ সাদী, হেয়াত মামুদ প্রমুখ। সৈয়দ সুলতানের নবীবংশ, মুহম্মদ খানের মকতুল হোসেন এবং শেখ চাঁদের রসুলবিজয়কে ইসলামি পুরাণ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।
আরাকানে বাংলা সাহিত্য মধ্যযুগের অন্তিম পর্বে বঙ্গদেশের সীমান্তবর্তী স্বাধীন ও অর্ধস্বাধীন রাজাদের রাজসভায় বাংলা সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য চর্চা হয়। উত্তরবঙ্গের কামতা-কামরূপের (অর্থাৎ কোচ রাজবংশের) রাজসভা, পূর্ববঙ্গের ত্রিপুরা ও আরাকানের (রোসাঙ্গ) রাজসভা এবং পশ্চিমবঙ্গে মল্লভূম-ধলভূমের রাজসভায় বাংলা ভাষায় বিবিধ কাব্যধারার সৃষ্টি হয়। এর মধ্যে আরাকানি ধারা বিশিষ্ট। ১৪৩০ খ্রিস্টাব্দে গৌড়ের করদ রাজ্যে পরিণত হওয়ার পর থেকে ১৬৪৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দুশ বছরেরও বেশি সময় ধরে আরাকানি রাজগণ বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতিদ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। তাই বাংলা ভাষা ও সাহিত্য উল্লেখযোগ্যভাবে তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে। এর পশ্চাতে সেখানকার বাংলাভাষী সভাসদ ও বিদ্বজ্জনদেরও অবদান ছিল। আরাকান রাজসভাতেই বাংলা ভাষার প্রথম মানবীয় প্রণয়কাব্য রচিত হয়। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে তাই আরাকান রাজসভার নাম সমুজ্জ্বল হয়ে আছে।
আরাকান রাজসভার উৎসাহ ও পৃষ্ঠপোষকতায় যাঁরা কাব্যচর্চা করেন তাঁদের মধ্যে দৌলত কাজী (আনু. ১৬০০-১৬৩৮) প্রাচীনতম। তাঁর সতীময়না ও লোরচন্দ্রানী প্রথম মানবীয় প্রণয়কাব্য। তিনি এ কাব্যের রচনা শুরু করেন, কিন্তু শেষ করে যেতে পারেননি; শেষ করেন আলাওল (আনু. ১৬০৭-১৬৮০)। এর মূল কাহিনী আওধী (গোহারি) ভাষায় উত্তর ভারতে প্রচলিত ছিল। কাব্যটি তিন খন্ডে বিভক্ত। এতে কবির অসাধারণ কবিত্বশক্তি ও সৌন্দর্যবোধ ফুটে উঠেছে। বৈষ্ণব পদাবলির ঢঙে তিনি নববর্ষার যে বর্ণনা দিয়েছেন, তা বাংলা ‘বারমাস্যার’ একঘেয়েমির ক্ষেত্রে এক অপূর্ব ব্যতিক্রম।
বাঙালি মুসলমান কবিদের মধ্যে আলাওল সর্বাধিক প্রসিদ্ধ। তাঁর মতো বহুগ্রন্থ প্রণেতা ও পন্ডিত কবি মধ্যযুগে বিরল। তিনি আরাকানের প্রধানমন্ত্রী কোরেশী মাগন ঠাকুরের (আনু. ১৬০০-১৬৬০) আশ্রয়ে থেকে কাব্যচর্চা শুরু করেন। পরবর্তী জীবনেও তিনি বহু সভাসদের অনুগ্রহে কাব্যসাধনা করেন। এ যাবৎ তাঁর যে পাঁচটি কাব্য পাওয়া গেছে তন্মধ্যে পদ্মাবতী শ্রেষ্ঠ। এটি হিন্দি কবি মালিক মুহম্মদ জায়সীর পদুমাবত (১৬৫১) অবলম্বনে রচিত হলেও মৌলিকতার কারণে পাঠকনন্দিত। তাঁর অপর চারটি কাব্যও অনুবাদমূলক এবং সেগুলি হলো হপ্তপয়কর, তোহফা, সয়ফুলমুলুক বদিউজ্জামাল ও সিকান্দরনামা। এগুলি ছাড়া আলাওল কিছু পদাবলি ও গানও রচনা করেন। তাঁর কাব্যে মানবপ্রেম ও অধ্যাত্মপ্রেম দুয়েরই মিলন ঘটেছে।
আরাকানের অন্যান্য কবি হচ্ছেন মরদন (আনু. ১৬০০-১৬৪৫), মাগন ঠাকুর প্রমুখ। মরদনের কাব্যের নাম নসীরনামা এবং মাগন ঠাকুরের কাব্যের নাম চন্দ্রাবতী। চন্দ্রাবতী একটি কাহিনীকাব্য এবং রূপকথা শ্রেণির অন্তর্গত। আবদুল করীম খোন্দকার ছিলেন আলাওল পরবর্তী শক্তিশালী কবি। দুল্লা মজলিস (ফারসি গ্রন্থের ভাবানুবাদ) নামে তাঁর একটি গ্রন্থ পাওয়া গেছে, যার রচনাকাল ১৬৯৮ খ্রিস্টাব্দ বলে ধরা হয়। এর আগে তিনি হাজার মসায়েল ও তমিম আনসারী নামে আরও দুটি কাব্য রচনা করেন বলে মনে করা হয়। তাঁর কাব্যগুলি ইসলাম ধর্মীয়।
অন্ত্য-মধ্যযুগ এ সময়টা নানা দিক থেকে বাংলার অবক্ষয় যুগ এবং রাজনৈতিক দিক থেকে নবাবি আমল হিসেবে চিহ্নিত। এ সময় মুগল সাম্রাজ্যের অবক্ষয়, বাংলার নবাবদের উত্থান-পতন, ইউরোপীয় বেনিয়া শক্তির আগ্রাসন এবং কোম্পানি আমলের শাসন প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপটে সাহিত্য সৃষ্টির স্বাভাবিক ধারা ব্যাহত হয়। ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে পলাশী যুদ্ধের পর থেকে ১৮০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সাহিত্য ক্ষেত্রে নবাবি আমলেরই জের চলতে থাকে। এ যুগেও তাই হিন্দু পৌরাণিক ও ইসলামি ভাবসমৃদ্ধ পদাবলি, মঙ্গলকাব্য, অনুবাদ ইত্যাদি সাহিত্যের ধারা অব্যাহত থাকে।
পদাবলি আঠারো শতকে যাঁরা পদ রচনা করেছেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন: নরহরি চক্রবর্তী, নটবর দাস, দীনবন্ধু দাস, চন্দ্রশেখর-শশিশেখর ও জগদানন্দ। এঁদের পদে অর্থ ও ভাবের বদলে চটুল ছন্দোবৈচিত্র্য বা ঝঙ্কারের প্রাধান্যই বেশি। বিশ্বনাথ চক্রবর্তীর ক্ষণদাগীতচিন্তামণি এ সময়কার একটি উল্লেখযোগ্য পদাবলি গ্রন্থ।
রামায়ণমূলক রচনা এ সময় ‘রায়বার’ নামে এক বিশিষ্ট ধারার সাহিত্য সৃষ্টি হয়। এর দ্বারা রাজদ্বার বা রাজস্ত্ততিকে বোঝাতো। এগুলি প্রকৃতপক্ষে রাজসভার স্থূল ও মুখরোচক কথোপকথন, যাকে পরবর্তীকালের খেউড়-তরজার পূর্বরূপ বলা চলে। আরেকটি ধারা হলো তরণীসেনের যুদ্ধ উপাখ্যান, যার সৃষ্টি হয়েছিল বাঙালি হিন্দুদের ভক্তিধর্মের প্রাবল্যের কারণে। এ দুটি কাহিনী তখনকার বাঙালি-উদ্ভাবনা হিসেবে স্মরণীয়। এরূপ উপাখ্যানের প্রধান রচয়িতা দ্বিজ দয়ারাম। রামানন্দ ঘোষের রামায়ণকাব্য (১৭৮০?) এবং জগৎরাম রায়ের অদ্ভুতরামায়ণও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
পাঁচালি কাব্য বিদ্যাসুন্দরের পাঁচালি বিদ্যাসুন্দর কাব্য অনেকটা রূপক বা আধ্যাত্মিক ভাবধারায় রচিত। বিদ্যাসুন্দর কাহিনীর উৎস কাশ্মীরী পন্ডিত বিহ্লনের (১২শ শতক) চৌরপঞ্চাশৎ বলে অনুমান করা হয়। এতে দেহভোগের প্রাবাল্য দেখা যায়। বাংলায় ষোলো শতকে দ্বিজ শ্রীধর ও কবি কঙ্ক এবং সতেরো শতকে গোবিন্দদাস, কৃষ্ণরাম দাস, প্রাণরাম চক্রবর্তী ও সাবিরিদ খান এ কাহিনী রচনা করেন। কাহিনীটি পরে ‘পালা’ হিসেবে কালিকামঙ্গলে যুক্ত হয়।
মঙ্গলকাব্য এ সময়ে ধর্মমঙ্গল ও শিবায়ন বা শিবমঙ্গল বিশেষ স্বাতন্ত্র্য লাভ করে। রামচন্দ্র যতির চন্ডীমঙ্গলও (১৭৬৬-৬৭) এ সময়ের উল্লেখযোগ্য মঙ্গলকাব্য। ধর্মমঙ্গলের কবিরা হলেন ঘনরাম চক্রবর্তী, নরসিংহ বসু, মাণিকরাম গাঙ্গুলী, রামকান্ত রায়, সহদেব চক্রবর্তী প্রমুখ। ঘনরাম চক্রবর্তী ‘কবিরত্ন’ উপাধিতে ভূষিত হন এবং সাহিত্যে তাঁর স্থান ছিল ভারতচন্দ্র ও রামপ্রসাদের পরেই। তাঁর ধর্মমঙ্গলে (১৭১১) উদার দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায়। বর্ধমানরাজ কীর্তিচন্দ্রের সমসাময়িক ছিলেন নরসিংহ বসু। মাণিকরাম গাঙ্গুলীর ধর্মমঙ্গলে (১৭৮১) ঘনরামের প্রভাব আছে। রামকান্ত রায়ের ধর্মমঙ্গলে বর্ণিত আত্মকাহিনীতে নতুনত্ব এসেছে বেকারত্বের সঙ্গে কাব্য-উপলক্ষের নাটকীয় বর্ণনায়। তাঁর কাব্যের রচনাকাল সম্ভবত ১৭৮৩ খ্রিস্টাব্দ। এ সময় নতুন দেবদেবীদের নিয়েও কিছু মঙ্গলকাব্য রচিত হয়, যেমন: সূর্যমঙ্গল, গঙ্গামঙ্গল, শীতলামঙ্গল, লক্ষ্মীমঙ্গল, ষষ্ঠীমঙ্গল, সরস্বতীমঙ্গল প্রভৃতি। এগুলির মধ্যে দুর্গাদাস মুখার্জীর গঙ্গাভক্তিতরঙ্গিণী উল্লেখযোগ্য।
আঠারো শতকে মঙ্গলকাব্যের শ্রেষ্ঠ কবি ভারতচন্দ্র। তাঁর মাধ্যমে একটা যুগের পরিণতি ঘটেছে। তাঁর প্রধান রচনা অন্নদামঙ্গল আটটি পালায় তিন খন্ডে বিভক্ত: শিবায়ন-অন্নদামঙ্গল, বিদ্যাসুন্দর-কালিকামঙ্গল ও মানসিংহ-অন্নপূর্ণামঙ্গল। খন্ডগুলির মধ্যে অন্নদা একটি ক্ষীণ যোগসূত্র রক্ষা করেন, যদিও তাঁর কৃপায় রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের পূর্বপুরুষ ভবানন্দের ভাগ্যোদয়ের ঘটনাই এ কাব্যের মূল বিষয়। বিদ্যাসুন্দরের রসালো কাহিনীটি আঠারো শতকের ধারা ও রুচির পরিচায়ক। তাঁর আরও কয়েকটি গ্রন্থ হলো সত্যনারায়ণের পাঁচালি, রসমঞ্জরী এবং সংস্কৃতে রচিত নাগাষ্টক ও গঙ্গাষ্টক।
অন্নদামঙ্গল পরবর্তীকালের কবিদের বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করেছে। কালিকামঙ্গলের কবিরা একে ব্যাপকভাবে অনুকরণ করেন। তাছাড়া প্রথম বাংলা ব্যাকরণ রচনায় হ্যালহেড (১৭৭৮) ও লেবেদেফ (১৮০১) এবং বাংলা অভিধান রচনায় (১৭৯৯-১৮০২) ফরস্টার অন্নদামঙ্গলের ভাষারই উদাহরণ দিয়েছেন। প্রকৃতপক্ষে অন্ত্য-মধ্যযুগে উঁচুমানের সাহিত্য ভারতচন্দ্রের হাতেই সৃষ্টি হয়েছে। ছন্দের চমৎকার প্রয়োগ, বিশাল শব্দসম্ভার, পদরচনায় লালিত্যগুণের সঞ্চার ইত্যাদি কারণে তাঁর কাব্য অনুপম হয়ে উঠেছে।
রামপ্রসাদ সেন ক্ষয়িষ্ণু যুগের কৃত্রিমতার মধ্যে বিশিষ্ট হয়ে ওঠেন তাঁর আন্তরিক ভক্তি ও সরল বাচনভঙ্গির জন্য। শাক্তপদাবলির কবি হিসেবে তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপন্ন হলেও তিনি বিদ্যাসুন্দর কাহিনী এবং কৃষ্ণকীর্তনও রচনা করেন। যে গানের জন্য রামপ্রসাদের এই শ্রেষ্ঠত্ব তাতে রয়েছে ঘরোয়া ভাবের ছোঁয়া এবং আধ্যাত্মিক ব্যাকুলতা। তাঁরই গানে ভয়ঙ্করী কালীদেবী হয়ে ওঠেন দয়াময়ী জননী।
লোকগাথা আঠারো শতকের অন্যতম সাহিত্যধারা। এর প্রধান বিষয় প্রণয়কাহিনী। অধিকাংশ লোকগাথাই ছিল অলিখিত, লোকমুখে প্রচলিত; ফলে সেগুলির ভাব, ভাষা ও উপমায় প্রক্ষেপণ ঘটেছে উনিশ শতক পর্যন্ত গাথাগুলির প্রায় সবটিতেই নারীর ভূমিকা প্রধান। এ ধারার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো মৈমনসিংহ-গীতিকা ও পূর্ববঙ্গ-গীতিকা। গীতিকাগুলির কালনির্ণয় দুরূহ। প্রথমটি দীনেশচন্দ্র সেন (১৮৬৬-১৯৩৯) ও দ্বিতীয়টি চন্দ্রকুমার দে ময়মনসিংহের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে সংগ্রহ করে প্রকাশ করেন। এগুলিতে পল্লীর লোকজীবন চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে।
অবক্ষয়িত সমাজ-মানসের বিস্রস্ত রুচির প্রকাশ ঘটে পাঁচালি, যাত্রা, তরজা, কবিগান ইত্যাদিতে। বাংলায় পাঁচালি গানের প্রচলন ছিল বহু আগে থেকেই। যাত্রার উদ্ভব হয় দেবদেবীদের বিভিন্ন উৎসব উপলক্ষে এবং কৃষ্ণলীলা ছিল এর মূল বিষয়; পরে অবশ্য বিদ্যাসুন্দর কাহিনীও এর সঙ্গে যুক্ত হয়। তরজার প্রচলন হয় চৈতন্যদেবের সময় থেকে এবং অবক্ষয়কালে তা হয়ে যায় উত্তর-প্রত্যুত্তর ঢঙের ছড়াগান। এ থেকে আবার আসে কবিগান, যা দুটি পক্ষের মাধ্যমে উপস্থাপিত হয়। এরই চরম রূপ হচ্ছে খেড় বা খেউড়।
যুগ-পরবির্তন সত্ত্বেও পূর্ববঙ্গে জারি গান, সারি গান ইত্যাদি লোকগীতির ধারা সচল থাকে; কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে নাগরিক সংস্কৃতির প্রভাবে পাঁচালি-কীর্তন ঢঙ বদলে আখড়াই ও পরে হাফ-আখড়াইতে পরিণত হয়। এই বিস্রস্ত ধারার মধ্য দিয়েই চলে আসে যুগান্তর।
আধুনিক যুগ বাংলা সাহিত্যের আধুনিক যুগের প্রথম পর্ব নির্মাণ করেন পাদ্রি আর সংস্কৃত পন্ডিতরা। তাঁদের গদ্যরচনার মধ্য দিয়ে প্রারম্ভিক স্তরটি নির্মিত হয়। দ্বিতীয় পর্বে আগমন ঘটে চিন্তাশীল ও সৃষ্টিশীল বাঙালি সাহিত্যিকদের। তৃতীয় পর্বের ব্যাপ্তি কম হলেও এর রচনাসম্ভার উৎকৃষ্ট ও প্রাচুর্যময় এবং গোটা সময়েই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১) প্রাধান্য বিস্তার করে আছেন। চতুর্থ পর্বের শুরু রবীন্দ্রনাথের জীবৎকালেই, যার স্থায়িত্ব ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ভারত বিভাগ পর্যন্ত; একে তিরিশোত্তর বা রবীন্দ্রোত্তর পর্বও বলা হয়। এরপর রাষ্ট্রীয় পরিস্থিতির পরিবর্তনের কারণে সাহিত্যিক ভাবধারারও পরিবর্তন ঘটে; ফলে বাংলা সাহিত্য পশ্চিমবঙ্গ, বিশেষত কলকাতা এবং সদ্যোজাত পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ) ভিত্তিক দুটি ধারায় বিভক্ত হয়ে যায়। তাই সবশেষে যে পর্বের সূচনা হয় তাকে এক কথায় বাংলাদেশ পর্ব (১৯৪৭-) বলা চলে।
প্রস্ত্ততিপর্ব সাহিত্যে নতুন যুগের সূচনা সাধারণত সুনির্দিষ্ট কোনো সন-তারিখ মেনে হয় না, কিন্তু বাংলা সাহিত্যে আধুনিক যুগের শুরু প্রায় সুনিশ্চিতভাবেই ১৮০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ধরা হয়। এ যুগ নানা দিক থেকে বাংলা সাহিত্যের বিকাশ, সমৃদ্ধি ও বেগবান হওয়ার যুগ; বিশ্ব দরবারে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য সুবিখ্যাত ও সমাদৃত হওয়ার যুগ।
প্রাচীন ও মধ্য যুগীয় বাংলা সাহিত্য শুধু পদ্যেই রচিত হতো। তখন সাহিত্যের বিষয়বস্ত্ত ছিল সীমাবদ্ধ এবং তাতে বাঙালি জীবনের প্রতিফলন ঘটত কম। প্রাচীন কবিদের জীবনী সম্পর্কেও নির্ভরযোগ্য তথ্যের অভাব ছিল। সাহিত্যচর্চা হতো প্রধানত রাজপৃষ্ঠপোষকতায়। আঠারো শতক পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের মূল লক্ষণগুলি হলো অনুকরণপ্রিয়তা, বৈচিত্র্যহীনতা, ধর্মমত প্রচারের প্রবণতা (প্রণয়কাব্য ও লোকগাথা ব্যতিক্রম) এবং হূদয়াবেগ ও ভাবোচ্ছ্বাসের আধিক্য।
উনিশ শতক হচ্ছে বাঙালির নবজাগরণের যুগ। এ সময় বাঙালি-প্রতিভার সর্বতোমুখী বিকাশ ঘটে এবং জাতি হিসেবে বাঙালির অভ্যুদয়ের সর্ববিধ প্রচেষ্টারও সূত্রপাত ঘটে। এ যুগেই একটি শক্তিশালী সাহিত্যেরও সৃষ্টি হয়। এ সময়ের বাংলা সাহিত্যের প্রধান কয়েকটি বিশেষত্ব হচ্ছে: ক. শক্তিশালী গদ্য-সাহিত্যের সৃষ্টি ও তার অসাধারণ বিকাশ; খ. উনিশ শতকের প্রথম পঞ্চাশ বছরের গদ্য-সাহিত্যে সংস্কৃত পন্ডিতদের প্রভাব; গ. বিশ্বসাহিত্য ও বিশ্বের আধুনিক চিন্তাধারার সঙ্গে বাংলা সাহিত্যের নিবিড় সংযোগ; ঘ. জ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক সাহিত্য সৃষ্টি; ঙ. সাময়িক সাহিত্য সৃষ্টি; চ. মান-বাংলা হিসেবে চলিত ভাষার সাহিত্যিক মর্যাদা লাভ ও পরবর্তী ধারায় এর ক্রমবর্ধিষ্ণু প্রভাব; ছ. কাব্য-সাহিত্যের অসামান্য উন্নতি; জ. সর্বদেশীয়, সর্বকালীয় ও সর্বজাতীয় সার্বভৌম সাহিত্য সৃষ্টির আদর্শ এবং ঝ. জাতীয় জীবনে সাহিত্যের প্রভাব সর্বাধিক অনুভূত হওয়া এবং সাহিত্যই যে জাতীয় চরিত্রের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মানদন্ড এ সত্য প্রতিষ্ঠিত হওয়া।
উপর্যুক্ত সংঘটনগুলির প্রেক্ষাপট বিবেচনা করলে দেখা যাবে যে, ১৭৫৭ সালে বঙ্গদেশের রাষ্ট্রক্ষমতা ইংরেজদের হস্তগত হলেও সাংস্কৃতিক জীবনে উনিশ শতকের পূর্বে ইংরেজি তথা পাশ্চাত্য প্রভাব অনুভূত হয়নি। প্রধানত ইংরেজদের শিক্ষা ও সাহিত্যের সঙ্গে পরিচয় ঘটার মধ্য দিয়েই আধুনিক যুগের সূত্রপাত হয় এবং বাঙালি বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় ইউরোপীয় সংস্কৃতির নিকটবর্তী হয়। মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগে যে সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিবর্তন ঘটে, তাকে ঐতিহাসিকগণ ‘নবজাগৃতি’ বা ‘রেনেসাঁ’ নামে আখ্যায়িত করেন। এর ফলস্বরূপ উনিশ শতকের সাহিত্যে মানব-প্রাধান্য, গদ্য-সাহিত্যের উদ্ভব, সাময়িক পত্রের আবির্ভাব ইত্যাদি বৈচিত্র্যের সূত্রপাত হয়। এ সময় উপন্যাস, ছোটগল্প, প্রবন্ধ প্রভৃতি বিচিত্র ধরনের গদ্য-সাহিত্য এবং ইংরেজির আদর্শে নাটক ও কাব্যসাহিত্য (মহাকাব্য-আখ্যায়িকা, সনেট, গীতিকবিতা) রচিত হতে থাকে; এমনকি ইউরোপীয় ধাঁচে নতুন নতুন রঙ্গমঞ্চও নির্মিত হতে থাকে।
গদ্যরচনার যুগ উনিশ শতকের পূর্বে বাংলায় যেসব গদ্য রচিত হয়েছিল তা সাহিত্যপদবাচ্য নয়। সতেরো শতকের শেষভাগে দোম আন্তোনিও ছিলেন প্রথম বাঙালি লেখক এবং তাঁর রচিত ব্রাহ্মণ-রোমান-ক্যাথলিক-সংবাদ প্রথম মুদ্রিত বাংলা গ্রন্থ। পরে পর্তুগিজ পাদ্রি মানোএল-দ্য আস্সুম্পসাঁও সংকলিত কৃপার শাস্ত্রের অর্থভেদ এবং বাঙ্গলা ব্যাকরণ ও বাঙ্গলা-পর্তুগীজ শব্দকোষ ১৭৪৩ খ্রিস্টাব্দে পর্তুগালের লিসবন শহর থেকে রোমান অক্ষরে মুদ্রিত হয়। রাষ্ট্রক্ষমতা লাভের পর ইংরেজ শাসকবর্গ দেশীয় ভাষা রপ্তকরণের আবশ্যকতা উপলব্ধি করেন। ইতোমধ্যে এদেশে মুদ্রণব্যবস্থা প্রচলিত হলে ইংরেজদের বাংলা শেখাবার উদ্দেশ্যে নাথানিয়েল ব্রাসি হ্যালহেড ১৭৭৬ খ্রিস্টাব্দে রচনা করেন A Grammar of the Bengal Language। গ্রন্থটি ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে হুগলি প্রেস থেকে মুদ্রিত হয় এবং এতে দৃষ্টান্তস্বরূপ উদাহরণ ও উদ্ধৃতিতে বাংলা হরফ ব্যবহূত হয়। এর কাছাকাছি সময়ে খ্রিস্টান পাদ্রিগণ বাংলা গদ্যে আরও কিছু পুস্তক রচনা করেন, যার সবগুলিরই উদ্দেশ্য ছিল ধর্মপ্রচার। এক কথায় বলা যায় যে, শাসনকার্য পরিচালনা ও ধর্মপ্রচারের প্রয়োজনেই আঠারো শতকে বাংলা গদ্যচর্চার প্রসার ঘটে; তাই তাতে সাহিত্য সৃষ্টি হয়নি। রাজকার্য পরিচালনায় আইনগ্রন্থের বাংলা অনুবাদই প্রথম প্রয়োজন হয়, তাই এ সময়ে কিছু আইন গ্রন্থের অনুবাদ প্রকাশিত হয়। এ ক্ষেত্রে ১৭৭৮ থেকে ১৮০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত হ্যালহেডের পরে উল্লেখযোগ্য হলেন ফরস্টার। তিনি কর্নওয়ালীসী কোড (১৭৯৩) ও শব্দকোষ (১৭৯৯) বাংলায় অনুবাদ করেন। এ দুটি মৌলিক রচনা না হলেও এ থেকে বাংলা গদ্যের প্রকৃতি সম্পর্কে ধারণা জন্মে। উনিশ শতকে এই গদ্য-প্রচেষ্টা আরও বেগবান ও সমৃদ্ধ হতে থাকে।
ইংরেজ সিভিলিয়ানদের ভারতীয় ভাষা ও বিভিন্ন বিষয়াদি শিক্ষা দেওয়ার উদ্দেশ্যে ১৮০০ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয় ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ। এখান থেকেই ধারাবাহিকভাবে বাংলা গদ্য রচনা ও চর্চার সূত্রপাত হয়। ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাংলা গদ্যের ক্ষেত্রে এই কলেজের অবদান ইতিহাস খ্যাত। শেষ দিকে বিদ্যাসাগরের মতো ব্যক্তিত্ব এখানে বাংলা বিভাগের অধ্যক্ষ ছিলেন।
বাংলা গদ্যচর্চায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন উইলিয়ম কেরী (১৭৬১-১৮৩৪) নামে একজন ইংরেজ কর্মকর্তা। তিনি বাংলা গদ্যচর্চাকে ধর্মপ্রচারের অনুরূপ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে গ্রহণ করেন। ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে শ্রীরামপুর মিশন থেকে বাইবেলের বঙ্গানুবাদ মথী রচিত মঙ্গল সমাচার প্রকাশের মধ্য দিয়ে তাঁর যাত্রা শুরু হয়। পরে তিনি ফোর্ট উইলিয়ম কলেজে গিয়ে গদ্যে পাঠ্যপুস্তক রচনা ও প্রকাশের কাজ আত্মনিয়োগ করেন। তাঁর নেতৃত্বে একদল বাঙালি পন্ডিত বাংলা পাঠ্যপুস্তক রচনা ও বাংলা ভাষা শিক্ষার কাজ শুরু করেন। এভাবে কেরী এবং ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের প্রচেষ্টায় বাংলা ভাষার একটা পরিকল্পিত ধারার প্রবর্তন ঘটে। কলেজের বাংলা বিভাগের পন্ডিত রামরাম বসু (১৭৫৭-১৮১৩) ও মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার (১৭৬২-১৮১৯) সর্বপ্রথম বাংলায় যথাক্রমে ফারসি ও সংস্কৃত শব্দ ব্যবহার করেন। এ ক্ষেত্রে অবশ্য কেরীর অবদানই বেশি। বাংলা ভাষার উৎকর্ষ সাধনে কেরী যে অবদান রাখেন, তার জন্য তিনি বঙ্গদেশ ও বাংলা ভাষার ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছেন।
ফোর্ট উইলিয়ম পর্বের বাংলা গদ্যের আটজন পন্ডিতের উল্লেখযোগ্য কর্ম হলো: উইলিয়ম কেরী কথোপকথন (১৮০১), বাংলা ভাষার ব্যাকরণ (১৮০১), ইতিহাসমালা (১৮১২), বাংলা-ইংরেজি অভিধান; রামরাম বসু রাজা প্রতাপাদিত্য চরিত্র (১৮০২), লিপিমালা (১৮০২); গোলকনাথ শর্মা হিতোপদেশ (১৮০২); মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার বত্রিশ সিংহাসন (১৮০২), হিতোপদেশ (১৮০৮), রাজাবলি (১৮০৮), প্রবোধচন্দ্রিকা (১৮৩৩); তারিণীচরণ মিত্র (১৭৭২-১৮৩৭) ওরিয়েন্টাল ফেবুলিস্ট (১৮০৩); রাজীবলোচন মুখোপাধ্যায় মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায়স্য চরিত্রং (১৮০৫); চন্ডীচরণ মুন্সী তোতা ইতিহাস (১৮০৫) এবং হরপ্রসাদ রায় পুরুষ পরীক্ষা (১৮১৫)।
পাঠ্যপুস্তক প্রসঙ্গ ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের পরে পাঠ্যপুস্তক রচনার উদ্যোগ নেয় কলিকাতা স্কুল-বুক সোসাইটি (১৮১৭)। এর প্রধান কয়েকজন লেখক ছিলেন: রামকমল সেন (১৭৮৩-১৮৪৪), রাধাকান্ত দেব (১৭৮৪-১৮৬৭), তারিণীচরণ মিত্র প্রমুখ। এঁদের গ্রন্থগুলি মূলত উপকথা-নীতিকথা ভিত্তিক। প্রকৃত পাঠ্যপুস্তক রচনা করেন শ্রীরামপুর কলেজের শিক্ষকগণ। পাঠ্যপুস্তকগুলিতে বিষয়গত প্রয়োজনই প্রাধান্য পায়, ফলে সেগুলির সাহিত্যমূল্য বিচার্য নয়; বরং উল্লেখ্য যে, বাংলা ভাষার পাঠকের কাছে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের কথা বলার যে আবশ্যকতা ছিল এবং তার জন্য যে ভাষা নির্মাণের প্রয়োজন ছিল তা এগুলিদ্বারা সম্পন্ন হয়েছে। এজন্য বিভাষা থেকে বিষয় ও শব্দ গ্রহণ করাও জরুরি ছিল।
রামমোহন পর্ব বাংলা গদ্যসাহিত্যের প্রথম উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি হলো সন্দর্ভ জাতীয় রচনা। এ ধারার প্রবর্তক রামমোহন রায় (১৭৭২-১৮৩৩)। তিনি বেদান্তের অনুবাদ এবং কিছু মৌলিক গ্রন্থও রচনা করেন। ব্রাহ্মধর্মের প্রচারক হিসেবে হিন্দু ধর্মবেত্তাদের সঙ্গে ধর্ম ও তত্ত্ববিষয়ক এবং সহমরণবিষয়ক সমাজসংস্কার আলোচনা তাঁর মৌলিক রচনার প্রধান বিষয়। তাঁর মৃত্যুর পর প্রকাশিত গৌড়ীয় ব্যাকরণের জন্যই তিনি সমধিক খ্যাত। এটি বাংলা ভাষায় রচিত প্রথম মৌলিক বাংলা ব্যাকরণ।
বাংলা গদ্যে রামমোহনের বিশিষ্টতা এই যে, তিনি পাঠ্যপুস্তকের বাইরে গদ্য ব্যবহারের পথ উন্মুক্ত করেন। এ সময় তাঁর প্রতিপক্ষ ছিলেন মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার, রাধাকান্ত দেব, রামকমল সেন, কাশীনাথ তর্কপঞ্চানন, ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৭৮৭-১৮৪৮) প্রমুখ এবং প্রধানত শ্রীরামপুরের মিশনারি পাদ্রিরা। ভবানীচরণের গদ্যরচনায় বাংলা কথ্যরীতির প্রথম সূচনা হয় এবং তাঁর সামাজিক নকশা জাতীয় রচনা বাংলা সাহিত্যে এক নতুন ধারার প্রবর্তন করে। রামমোহনের স্বপক্ষে ছিলেন রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশ, দ্বারকানাথ ঠাকুর (১৭৯৪-১৮৪৬), প্রসন্নকুমার ঠাকুর, তারাচাঁদ চক্রবর্তী (১৮০৬-১৮৫৭), চন্দ্রশেখর দেব, গৌরীকান্ত ভট্টাচার্য (জ্ঞানাঞ্জন), গৌরমোহন বিদ্যালঙ্কার (স্ত্রীশিক্ষা বিধায়ক), কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮১৩-১৮৮৫) প্রমুখ। এ সময় বাংলা গদ্য ব্যবহারের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম ছিল সাময়িক পত্র ও সংবাদপত্র। এছাড়া পক্ষ-প্রতিপক্ষের প্রচারণামূলক এক ধরনের রচনার প্রচলন হয়েছিল, যা পরবর্তীকালে ‘দ্বৈরথ দ্বন্দ্ব’ (Polemics) নামে পরিচিত হয়।
ওই সময়কার অন্যান্য গদ্য রচয়িতার মধ্যে প্রথমেই উল্লেখযোগ্য প্যারীচাঁদ মিত্র (১৮১৪-১৮৮৩)। তিনি প্রথম বাংলা উপন্যাস এবং কথ্য ভাষার ব্যবহারে গদ্য রচনার জন্য বিখ্যাত হলেও নানা বিষয়ে প্রবন্ধ রচনা করেও খ্যাতি অর্জন করেন। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের (১৮১৭-১৯০৫) গদ্য কবিত্বময়, স্নিগ্ধ ও অন্তরঙ্গ। অক্ষয়কুমার দত্ত (১৮২০-১৮৮৬) বাংলা গদ্যকে যুক্তি ও বিজ্ঞানচর্চার উপযোগী করে তোলেন। তাঁর রচনায় বাহ্য প্রকৃতির সঙ্গে মানব প্রকৃতির সম্বন্ধবিচার স্থান পেয়েছে। তাঁর সর্বাধিক পরিচিত গ্রন্থ হচ্ছে কিশোর শিক্ষার্থীদের জন্য রচিত চারুপাঠ।
বাংলায় সাময়িক পত্রপত্রিকা এবং সংবাদপত্রের সূচনা বাংলা গদ্যের ইতিহাসকে বিনির্মাণ ও নিয়ন্ত্রণ করেছে। বাংলা সাহিত্যের ক্রমবিকাশে উনিশ শতকের দ্বিতীয় দশক থেকে বিবিধ সাময়িক পত্র-পত্রিকা নানাভাবে সাহায্য করেছে, যার ধারা একাল পর্যন্ত অব্যাহত। শ্রীরামপুরের পাদ্রিরা প্রথম সংবাদপত্র প্রকাশের কৃতিত্ব অর্জন করেন মাসিক দিগ্দর্শনের (এপ্রিল ১৮১৮) মাধ্যমে। ১৮১৮ থেকে ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে প্রকাশিত নিয়মিত-অনিয়মিত পত্র-পত্রিকার মধ্যে প্রধান কয়েকটি এবং সংশ্লিলষ্ট ব্যক্তিবর্গ হলেন: সমাচারদর্পণ (১৮১৮) জন ক্লার্ক মার্শম্যান; সম্বাদকৌমুদী (১৮২১) তারাচাঁদ দত্ত ও ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়; সমাচার চন্দ্রিকা (১৮২২) ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং বঙ্গদূত (১৮২৯) নীলমণি হালদার। পরে এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা। ১৮৪৩ খ্রিস্টাব্দে ব্রাহ্মসমাজের মুখপত্র হিসেবে প্রকাশিত এ পত্রিকায় অক্ষয়কুমার দত্ত, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০-১৮৯১), দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, রাজনারায়ণ বসু (১৮২৬-১৮৯৯), দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৪০-১৯২৬) প্রমুখ এ যুগের শ্রেষ্ঠ গদ্যলেখক নিয়মিত লিখে বাংলা সাহিত্যে একটা যুগের সৃষ্টি করেন। জ্ঞানবিজ্ঞান ও দর্শনসংক্রান্ত রচনায় এ পত্রিকাটিকে যাঁরা সমৃদ্ধ করেন তাঁরা ছিলেন সংস্কারপন্থী এবং এটিকে কেন্দ্র করেই সে সময়ের সাহিত্য-সাধনায় বাঙালি জাতির কল্যাণ সাধিত হয়েছিল। এর লেখকগোষ্ঠীর মধ্যে অক্ষয়কুমার দত্ত ছিলেন নানা কারণে উল্লেলখযোগ্য। তিনি দীর্ঘ বারো বছর এর সম্পাদক ছিলেন।
ইয়ং বেঙ্গল প্রসঙ্গ বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে বিশিষ্ট ধারা প্রবর্তনে প্রত্যক্ষ প্রভাব ফেলেন ইয়ং বেঙ্গল সদস্যরা। পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবে তাঁরা ছিলেন প্রচলিত ধর্মীয় সংস্কারের বিরোধী। তাঁরা নির্বিচারে কোন কিছু গ্রহণ করতেন না। তাঁদের চিন্তা ও কর্ম তখনকার (১৮৩১-১৮৫৭) বাঙালি সমাজকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। তাঁদের মধ্যে অনেকেই বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছেন। প্যারীচাঁদ মিত্রের নাম এ ক্ষেত্রে প্রথমেই উল্লেখযোগ্য। ‘টেকচাঁদ ঠাকুর’ ছদ্মনামে রচিত তাঁর আলালের ঘরের দুলাল (১৮৫৮) বাংলা ভাষায় প্রথম উপন্যাস। এতে তিনি আরবি-ফারসি-হিন্দুস্থানি মিশ্রিত সাধারণ মানুষের মুখের ভাষা ব্যবহার করেন। ভাষাগত কারণেও উপন্যাসটি সমকালে এবং পরবর্তীকালে প্রচুর খ্যাতি অর্জন করে। তাঁর অন্যান্য রচনায়ও ভাষা ব্যবহারের এই স্বাতন্ত্র্য বিদ্যমান, যে কারণে বাংলা গদ্যের প্রথম যুগে ‘আলালি গদ্য’ নামে তাঁর ভাষাকে পৃথক মর্যাদা দেওয়া হয়।
প্যারীচাঁদের অনুসরণে বাংলা ভাষাকে আরও গণমুখী করেন কালীপ্রসন্ন সিংহ (১৮৪০-১৮৭০)। কলকাতা এবং তৎসংলগ্ন এলাকার মৌখিক ভাষাকে তিনি সার্থকভাবে তাঁর রচনায় প্রয়োগ করেন। তাঁর হুতোম প্যাঁচার নকশা (১৮৬২) উপন্যাসে ব্যবহূত ভাষারীতি প্যারীচাঁদের ভাষার চেয়ে মার্জিততর। এ গ্রন্থে চলিত ভাষায় সরস ব্যঙ্গবিদ্রূপের মাধ্যমে কলকাতার সমাজজীবন চিত্রিত হয়েছে। স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের কারণে তাঁর ভাষা ‘হুতোমি ভাষা’ নামে পরিচিত, যা পরবর্তী শতকের গদ্যরচনায় বিশেষ প্রভাব ফেলে।
আধুনিক বাংলা গদ্যের প্রধান রূপকার ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর নানাভাবে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেন। শিক্ষাবিস্তারের প্রয়োজনে তিনি পাঠ্যপুস্তক রচনা করেন এবং পরবর্তীকালে সমাজসংস্কারের ক্ষেত্রে নিজস্ব রীতিতে গদ্যচর্চা করেন। উনিশ শতকের মানবতাবাদে যেমন, বাংলা গদ্যের সার্থক শিল্পরূপ নির্মাণের ক্ষেত্রেও তেমনি তিনি খ্যাতি অর্জন করেন। রামমোহন বাংলা গদ্যের কাঠামো তৈরি করেন, আর বিদ্যাসাগর তাতে প্রাণসঞ্চার ও সৌন্দর্য সংযোজন করেন। বিদ্যাসাগরের রচনাকে চারটি ধারায় ভাগ করা যায়: সমাজবিষয়ক রচনা, রম্যরচনা, পাঠ্যপুস্তক ও সাহিত্যধর্মী রচনা। তাঁর রচনার প্রধান বৈশিষ্ট্য বাংলা গদ্যে সাবলীল গতিভঙ্গি তথা অন্তর্নিহিত ছন্দ আবিষ্কার এবং বিরামচিহ্নের যথাযথ ব্যবহার। উনিশ শতকের বাংলা গদ্যের প্রধান পরিকল্পনাকারী ও নিয়ন্ত্রক ছিলেন বিদ্যাসাগর। তিনি বাংলা সাধুগদ্যের একটা আদর্শ রূপ দেন, যার ধারাবাহিকতায় পরবর্তীকালের লেখকগণ অনুপম সাহিত্য সৃষ্টি করতে সক্ষম হন।
প্রবন্ধের সুসংবদ্ধ বক্তব্যের জন্য উপযুক্ত গদ্য রচনা করেন ভূদেব মুখোপাধ্যায় (১৮২৭-১৮৯৪)। তাঁর রচনার বিষয় সমাজ, শিক্ষা, ইতিহাস, বিজ্ঞান, ধর্ম ইত্যাদি; আর এ কারণেই রচনার শিথিল ভঙ্গি তাতে গ্রাহ্য হয়নি। এ সময়ের অন্যতম প্রধান পন্ডিত রাজেন্দ্রলাল মিত্রের (১৮২২-১৮৯১) অধিকাংশ রচনা ইংরেজিতে হলেও বাংলায় তিনি খ্যাত মাসিক পত্রিকা বিবিধার্থ সংগ্রহ (১৮৫১), রহস্যসন্দর্ভ (১৮৫১) ও বিবিধার্থ সংগ্রহ সন্দর্ভ-এর (১৮৬৩) জন্য। প্রথমটিতে সূচনা হয় গ্রন্থ সমালোচনার। এ ধারায় রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮২৭-১৮৮৭) ১৮৫২ সালে প্রকাশ করেন বাংলার প্রথম সাহিত্য সমালোচনামূলক একটি গ্রন্থ। রাজনারায়ণ বসুর সেকাল আর একাল (১৮৭৪), হিন্দু কলেজ অথবা প্রেসিডেন্সি কলেজের বৃত্তান্ত (১৮৭৬), বাঙ্গালা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ক বক্তৃতা (১৮৭৮) এবং আত্মচরিত-এ (১৯০১) পাওয়া যায় মননশীলতার গভীর পরিচয়। রামগতি ন্যায়রত্ন (১৮৩১-১৮৯৪) বাংলা সাহিত্যের প্রথম বিস্তৃত ইতিহাস বাঙ্গালা ভাষা ও বাঙ্গালা সাহিত্য বিষয়ক প্রস্তাব (১৮৭২, ১৮৭৩) রচনা করেন। পাঠ্যপুস্তকের লেখক মদনমোহন তর্কালঙ্কার (১৮১৭-১৮৫৮) বিদ্যাসাগর পর্বের একজন উল্লেখলযোগ্য লেখক ছিলেন।
বিকাশের যুগ এ পর্বের শ্রেষ্ঠ লেখক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৩৮-১৮৯৪)। তিনি বাংলা গদ্যকে সর্বপ্রকার ভাব প্রকাশের উপযোগী করে তোলেন। বঙ্কিমচন্দ্র বাংলা সাহিত্য ও বাঙালি জীবনে অসামান্য প্রভাব বিস্তার করেন। তিনি তাঁর অসাধারণ প্রতিভাগুণে পন্ডিতি ও আলালি-হুতোমি রীতির মধ্যে সামঞ্জস্য স্থাপন করে সরল ও সরস গদ্যের সৃষ্টি করেন। বঙ্গদর্শন (১৮৭২) নামক সাহিত্য-বিষয়ক মাসিক পত্রিকা সম্পাদনার মাধ্যমে তিনি সাহিত্যের ইতিহাসে এক নবযুগের সূচনা করেন। সাহিত্য-সমালোচনা, ঐতিহাসিক গবেষণা, ধর্ম ও দার্শনিক আলোচনা, রাজনৈতিক ও বৈজ্ঞানিক সাহিত্য, ব্যঙ্গ-সাহিত্য এর সবই তিনি প্রবর্তন করেন। বঙ্কিমচন্দ্রের প্রতিভাবলে যে সাহিত্যিক গোষ্ঠী গড়ে ওঠে, তাঁরাই দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর যাবৎ বাংলা সাহিত্যে আধিপত্য করেন। বাংলায় তুলনামূলক সাহিত্যসমালোচনারও তিনিই পথিকৃৎ। তবে তাঁর প্রধান পরিচয় ঔপন্যাসিক হিসেবে এবং এজন্য তিনি ‘সাহিত্যসম্রাট’ উপাধিতে ভূষিত হন। তাঁর রচিত বিখ্যাত উপন্যাস দুর্গেশনন্দিনী, কপালকুন্ডলা, কৃষ্ণকান্তের উইল, বিষবৃক্ষ, আনন্দমঠ ইত্যাদি।
এ সময়ের অন্যান্য বিশিষ্ট লেখকের মধ্যে প্রথমেই উল্লেখযোগ্য বঙ্কিমচন্দ্রের অগ্রজ সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৩৪-১৮৮৯)। তাঁর সার্থক সৃষ্টি পালামৌ চমৎকার এক ভ্রমণকাহিনী। তিনি উপন্যাস রচনায়ও খ্যাতি অর্জন করেন। আরেকজন গুণী লেখক হলেন রমেশচন্দ্র দত্ত (১৮৪৮-১৯০৯)। বাংলা সাহিত্যে তাঁর পরিচয় ঐতিহাসিক উপন্যাস রচয়িতা হিসেবে। উপন্যাসে তিনি বাংলার ইতিহাস ও সমাজকে তুলে ধরেন। রবীন্দ্রনাথের অগ্রজা স্বর্ণকুমারী দেবীর (১৮৫৫-১৯৩২) ছিল বিচিত্র ধরনের সাহিত্য সৃষ্টির ক্ষমতা। কবিতা ও নাট্যরচনায় দক্ষতার পরিচয় দিলেও উপন্যাস রচনায়ই তাঁর সর্বাধিক কৃতিত্ব। সমকালীন সমাজ-জীবনের আদর্শ-সংঘাতের ছায়া স্বর্ণকুমারীর সামাজিক উপন্যাসে গভীরভাবে পড়েছে। তাঁর সম্পাদিত ভারতী পত্রিকা সমকালে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করে। ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায় (১৮৪৭-১৯১৯) ছোট-বড় সকলের অবসর বিনোদনের জন্য বিচিত্র কাহিনী সৃষ্টি করেন। তিনি চারটি উপন্যাস ও চারটি গল্পগ্রন্থ রচনা করেন; তবে উপন্যাসের তুলনায় গল্প রচনায় তাঁর সফলতা বেশি। তাঁর সমসাময়িক ইন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৪৯-১৯২২) ব্যঙ্গাত্মক নকশা ও উপন্যাস রচনায় সমকালীন কথাসাহিত্যে হাস্যরসের ধারা প্রবর্তন করেন। এ সময়ের আরও কয়েকজন প্রতিষ্ঠিত গদ্যলেখক হচ্ছেন প্রতাপচন্দ্র ঘোষ (১৮৪৫-১৯২১), শিবনাথ শাস্ত্রী (১৮৪৭-১৯১৯), চন্দ্রশেখর মুখোপাধ্যায় (১৮৪৯-১৯১১), হরপ্রসাদ শাস্ত্রী (১৮৫৩-১৯৩১), দামোদর মুখোপাধ্যায় (১৮৫৩-১৯০৭), শ্রীশচন্দ্র মজুমদার (১৮৬০-১৯০৮), নগেন্দ্রনাথ গুপ্ত (১৮৬১-১৯৪০) প্রমুখ।
প্রবন্ধ রচনার ধারা এ ধারার সূত্রপাত হয় ভূদেব মুখোপাধ্যায়ের হাতে, কিন্তু পরিণতি লাভ হয় বঙ্কিমচন্দ্রের হাতে। ভাষা, সাহিত্য, সমাজ, ধর্ম, দর্শন, বিজ্ঞান প্রভৃতি বিষয়ে গভীর মননশীল প্রবন্ধ রচনা করে বঙ্কিমচন্দ্র এ ধারাকে সমৃদ্ধ করেন। বিজ্ঞান রহস্য (১৮৭৫), বিবিধ সমালোচনা (১৮৭৬), কৃষ্ণচরিত্র (১৮৮৬) প্রভৃতি তাঁর এ জাতীয় রচনা। এ ধারায় পরবর্তীকালে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন আরো অনেকে। বঙ্কিমের অগ্রজ সঞ্জীবচন্দ্র লেখেন যাত্রা-সমালোচনা (১৮৭৫), বাল্যবিবাহ (১৮৮২) ইত্যাদি। দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর মননশীল প্রাবন্ধিক হিসেবে ছিলেন অনন্য, এমনকি তাঁর ভাষাতাত্ত্বিক প্রবন্ধও ছিল সে সময়ের জন্য অভাবিত। উনিশ শতকের শেষ দশকে বাংলা ভাষা বিশ্লেষণে যে একটি নতুন ধারার সূত্রপাত হয়, তিনি ছিলেন তার সূচনাকারী। অন্যান্য প্রাবন্ধিকের মধ্যে ছিলেন ধর্মীয় প্রবন্ধের লেখক ত্রৈলোক্যনাথ সান্যাল (১৮৪০-১৯১৬), বান্ধব পত্রিকার (১৮৭৪) সম্পাদক কালীপ্রসন্ন ঘোষ (১৮৪৩-১৯১০), রক্ষণশীল চন্দ্রনাথ বসু (১৮৪৪-১৯১০), বাংলা ভাষায় প্রত্নতত্ত্ব আলোচনার সূচনাকারী রামদাস সেন (১৮৪৫-১৮৮৭), ধর্মতাত্ত্বিক ও সমাজ-ঐতিহাসিক শিবনাথ শাস্ত্রী যিনি রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ (১৮৯৭) গ্রন্থের জন্য স্মরণীয়, সুলেখক পূর্ণচন্দ্র বসু, উদ্ভ্রান্ত প্রেমের লেখক চন্দ্রশেখর মুখোপাধ্যায় (১৮৪৯-১৯২২), পুরাতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক রজনীকান্ত গুপ্ত (১৮৪৯-১৯০০), স্বর্ণকুমারী দেবী, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী প্রমুখ।
অন্যান্য প্রবন্ধ প্রণেতার মধ্যে হযরত মুহাম্মাদ (সঃ) -এর জীবনী লেখক শেখ আবদুর রহিম (১৮৫৯-১৯৩১), রেয়াজউদ্দীন আহমদ মাশহাদী (১৮৫৯-১৯১৮), মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক (১৮৬০-১৯৩৩), সংস্কৃত সাহিত্য বিষয়ের লেখক ত্রৈলোক্যনাথ ভট্টাচার্য (১৮৬০-১৯০৩), ঐতিহাসিক প্রবন্ধ রচয়িতা অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় (১৮৬১-১৯৩০) প্রমুখ বিখ্যাত। বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যের ক্ষেত্রে উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে নতুন ধারার প্রবর্তন করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
আধুনিক সাহিত্যে বাঙালি মুসলমান কবি মধ্যযুগের পর দীর্ঘকাল যাবৎ বাঙালি মুসলমান কবিদের উল্লেখযোগ্য কোনো সাহিত্যিক অবদান দেখা যায় না। মুসলমানদের নিকট থেকে ইংরেজ রাজশক্তির ক্ষমতা দখলের কারণে মুসলমানদের মধ্যে এক গ্লানিময় অধ্যায়ের সৃষ্টি হয়। ইংরেজের কোম্পানি শাসন এবং আধুনিক সভ্যতা কোনটাই তারা মেনে নেয়নি। হিন্দুসমাজে যখন ইয়ং বেঙ্গলদের আধুনিকতার চর্চা চলছিল, সে সময়ে তিতুমীরের নেতৃত্বে মুসলমানদের অভ্যুত্থান (১৮৩১) এবং পরবর্তী পর্যায়ে তাদের রাজনৈতিক-সামাজিক পর্যায়ে ইংরেজবিরোধ ছিল সুস্পষ্ট। এর ফলে ইংরেজি শিক্ষার প্রতি মুসলমানরা দীর্ঘকাল উদাসীন থাকে। এসব কারণে আধুনিক বাংলা সাহিত্যে তাদের আগমন ঘটে অনেক বিলম্বে।
বটতলার পুথি সিপাহি বিপ্লবের (১৮৫৭-৫৮) পরে যখন মুসলমানরা আধুনিক বাংলা সাহিত্য-চর্চায় এগিয়ে আসেন তখনও তাঁদের মধ্যে বিশুদ্ধ বাংলায় সাহিত্যচর্চার পরিবেশ সৃষ্টি হয়নি। আধুনিক শিক্ষা ও জ্ঞানের বাইরে থেকে অতীত গৌরবের কথা নিয়ে তাঁরা পুরো শতাব্দী ধরেই রচনা করেন দোভাষী পুথি। উর্দু, ফারসি ও হিন্দি শব্দবহুল এসব পুথির ভাষা ছিল সাধু শ্রেণির। যুগপ্রভাবে স্বভাবতই এ ভাষা ওহাবী বা ফরায়েজী আন্দোলন-প্রেরণায় পুষ্ট ছিল এবং তাতে ধর্মীয় প্রভাবও ছিল পর্যাপ্ত পরিমাণে। পরবর্তী পর্যায়ে ছাপাখানা ও পুস্তক ব্যবসার প্রসারের ফলে উনিশ শতকে এগুলি পরিচিত হয় বটতলার পুথি নামে। এ ধারার সাহিত্য তখন বিরাট জনগোষ্ঠীর সাহিত্য-পিপাসা মিটিয়েছে। সমগ্র বঙ্গদেশের মুসলমান জনসাধারণের মধ্যে সাংস্কৃতিক যোগাযোগ স্থাপনের জন্য যেভাবে এ সাহিত্য রচিত ও চর্চিত হয়েছে, পৃথিবীর অন্য কোনো দেশের সাহিত্যের ইতিহাসে তার নজির পাওয়া যায় না।
প্রধান বাঙালি মুসলমান লেখক উনিশ শতকে রাজনীতি সম্পর্কে বাংলার মধ্যবিত্ত শ্রেণির মুসলমানদের মনোভাবের পরিবর্তন ঘটার পর থেকে বাংলা সাহিত্যে বেশ কিছু প্রতিভাবান সাহিত্যিকের আবির্ভাব ঘটে। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন হলেন: মীর মশাররফ হোসেন (১৮৪৭-১৯১২), মৌলবি মোহাম্মদ নঈমুদ্দীন (১৮৩২-১৯০৭), দাদ আলী (১৮৫২-১৯৩৬), কায়কোবাদ (১৮৫৭-১৯৫১), শেখ আবদুর রহিম, রেয়াজউদ্দীন মাশহাদী, মোজাম্মেল হক, মুনশি মোহাম্মদ রেয়াজউদ্দীন আহমদ (১৮৬২-১৯৩৩), মৌলবি মেয়রাজউদ্দীন আহমদ (১৮৫২-১৯২৯), মুনশি মোহাম্মদ জমিরউদ্দীন (১৮৭০-১৯৩০), আবদুল হামিদ খান ইউসুফজয়ী (১৮৪৫-১৯১৫), আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ (১৮৭১-১৯৫৩), নওশের আলী খান ইউসুফজয়ী (১৮৬৪-১৯২৪), মওলানা মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী (১৮৭৫-১৯৫০) প্রমুখ। মীর মশাররফ হোসেন ছিলেন আধুনিক যুগের মুসলমান বাংলা সাহিত্যিকদের অগ্রগণ্য। সমগ্র বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসেও তিনি অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক। উপন্যাস, নাটক, প্রহসন, কাব্য, গীতিনাট্য, প্রবন্ধ-সাহিত্য, সমাজচিত্র প্রভৃতি বিষয়ে তিনি প্রায় ৩০টি গ্রন্থ রচনা করেন; তবে উপন্যাস ও কাহিনী জাতীয় রচনাতেই তাঁর অবদান সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর রচনার ব্যাপ্তি ও বৈচিত্র্য পরবর্তী যুগের বাঙালি মুসলমান সাহিত্যিকদের অনুপ্রেরণা ও উদ্দীপনা জুগিয়েছে। বিষাদ-সিন্ধু তাঁর শ্রেষ্ঠ রচনা।
মশাররফের পরে অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক হলেন মোজাম্মেল হক। গদ্য ও পদ্য রচনায় অসামান্য কৃতিত্বের অধিকারী মোজাম্মেল হক প্রধানত মুসলমান সমাজের জাগরণমূলক কাব্য রচনা করলেও তাঁর প্রতিভার বিকাশ ঘটে মূলত গদ্যে। তিনি জীবনচরিত ও উপন্যাস রচনায় এবং ফারসি থেকে অনুবাদে কৃতিত্ব অর্জন করেন। মুসলমানদের জন্য সর্বপ্রথম পাঠ্যপুস্তক রচনাও তাঁর অন্যতম কৃতিত্ব। মূল ফারসি থেকে শাহনামা কাব্যের প্রথমাংশের অনুবাদ তাঁর অমর কীর্তি। শেখ আবদুর রহিমের কৃতিত্ব হজরত মোহাম্মদের (দ.) জীবন-চরিত ও ধর্মনীতি নামে বাঙালিদের মধ্যে প্রথম হযরত (স.)-এর জীবনী রচনা। পন্ডিত রেয়াজউদ্দীন আহমদ মাশহাদী সমাজ সংস্কারক গ্রন্থের জন্য সমধিক খ্যাত। মুসলমান সমাজকে সংঘবদ্ধ করা এবং ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্পর্কে জামালুদ্দীন আফগানীর বৈপ্লবিক চিন্তাধারা প্রচারের কারণে প্রকাশের অল্প পরেই এ গ্রন্থটি সরকার বাজেয়াপ্ত করে।
প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলা কাব্যের ঋদ্ধ ও বেগবান ধারা উনিশ শতকের প্রথমার্ধে এসে প্রায় শুষ্ক অবস্থায় পতিত হয়। এ সময়ের উল্লেখযোগ্য কবি ছিলেন কেবল ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত (১৮১২-১৮৫৯)। তাঁকে বলা হয় যুগসন্ধির কবি। নিজের সম্পাদিত সংবাদ প্রভাকরে তিনি নিজের এবং অন্যদের কবিতাও প্রকাশ করতেন। তাঁর মহান কীর্তি হলো প্রাচীন কবিদের জীবনী ও কাব্য সংগ্রহ করে প্রকাশ করা।
ঈশ্বরগুপ্তের কবিতায় সে সময়ের সামাজিক ও রাজনৈতিক ঘটনা প্রকাশ পায়। উনিশ শতকের নতুন সাহিত্য ছিল নাগরিকজনদের জন্য লেখা এবং সাহিত্যিকরা ছিলেন নাগরিক সংস্কৃতিপুষ্ট; তাই তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গিও ছিল প্রসারিত। ঈশ্বরগুপ্তের মধ্যে প্রথম সেই লক্ষণ দেখা যায় ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দ থেকে প্রকাশিত তাঁর সংবাদ প্রভাকর পত্রিকায়। তখনকার কলকাতায় নতুন সাহিত্য ও জীবনধারা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এর অবদান ছিল খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। এক সময় তা বাংলা সাহিত্যের দিকনির্দেশ ও নীতিনির্ধারণ করেছে। রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, অক্ষয়কুমার দত্ত, দীনবন্ধু মিত্র, মনোমোহন বসু, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো লব্ধপ্রতিষ্ঠ লেখকরা ঈশ্বরগুপ্তের নিকট বিশেষভাবে ঋণী ছিলেন।
১৮৫৮ সাল বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে নানা দিক থেকে তাৎপর্যপূর্ণ। এ সময় যুগসন্ধির কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের মৃত্যু হয়, প্রথম বাংলা উপন্যাস আলালের ঘরের দুলাল প্রকাশিত হয় এবং বাংলা সাহিত্যে মাইকেল মধুসূদন দত্তের (১৮২৪-১৮৭৩) আত্মপ্রকাশ ঘটে। মধুসূদন শর্মিষ্ঠা নাটক রচনার মধ্য দিয়ে বাংলা সাহিত্যে আবির্ভূত হন। একই সঙ্গে বাংলা কাব্যেও তিনি বিপ্লব ঘটান। বাংলা কাব্যে অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্তন তাঁর অক্ষয় কীর্তি। এ ছন্দে রচিত তাঁর মেঘনাদবধ কাব্য (১৮৬১) বাংলা সাহিত্যে এক অনুপম সৃষ্টি এবং মধুসূদনেরও শ্রেষ্ঠ রচনা। এর বিষয় ও ভাষা প্রাচ্যদেশীয় হলেও ভাব ও রচনারীতি পাশ্চাত্যের। মধুসূদনে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সার্থক মিলন ঘটেছে।
মধুসূদন মেঘনাদবধ রচনার কিছুকাল পরে ইউরোপ চলে যান এবং প্রবাসে বসে সনেট লিখতে শুরু করেন, যা চতুর্দ্দশপদী কবিতাবলী নামে ১৮৬৬ সালে প্রকাশিত হয়। কিছু গীতিকবিতা ও কিশোরতোষ নীতিমূলক কবিতাও তিনি রচনা করেন। অমিত্রাক্ষর ছন্দ ও সনেটের মতো বাংলা সাহিত্যে প্রথম বিয়োগান্ত নাটক রচনার কৃতিত্বও মধুসূদনের। বস্ত্তত মধুসূদনের দ্বারাই বাংলা কাব্যে আধুনিকতার সূত্রপাত হয় এবং বাংলা সাহিত্য বিশ্বসাহিত্যের মর্যাদা লাভ করে।
মধুসূদনের পরে বাংলা কাব্যের ইতিহাসে উল্লিলখিত হন হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৩৮-১৯০৩) ও নবীনচন্দ্র সেন (১৮৪৭-১৯০৯)। হেমচন্দ্রের শ্রেষ্ঠ কীর্তি মহাভারতের কাহিনী অবলম্বনে রচিত সুবৃহৎ মহাকাব্য বৃত্রসংহার (১৮৭৫)। এতে সাধনার জয় ও স্বাজাত্যবোধ তুলে ধরা হয়েছে। উনিশ শতকের হিন্দুধর্মীয় বিশ্বাস ও আচারনিষ্ঠাকে কবি পূর্ণ মর্যাদা দেন এবং কাব্যের বিভিন্ন আঙ্গিক নিয়েও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন। নবীনচন্দ্র আখ্যানকাব্য, খন্ডকবিতা এবং মহাকাব্য রচনা করে খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি মধুসূদনের দ্বারা প্রভাবিত হলেও তাঁর রচনাভঙ্গি ততটা অনুসরণ করেননি। কাব্যক্ষেত্রে তাঁর খ্যাতি প্রধানত দুটি কারণে জাতীয়তাবাদের পোষণ ও সনাতন ধর্মবিশ্বাস। তাঁর প্রধান কাব্যগ্রন্থ পলাশীর যুদ্ধ (১৮৭৫) প্রকাশে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার তাঁর প্রতি ক্ষুব্ধ হয়।
গীতিকাব্য ধারা বাংলা সাহিত্যের এ ধারার প্রথম প্রকাশ ঘটে মধ্যযুগের বৈষ্ণবকবিতায়। পরবর্তীকালে এর নবরূপ প্রকাশ পায় প্রধানত কবিগান ও যাত্রার মাধ্য দিয়ে। কবিগান, যাত্রা, লোকগাথা, পাঁচালি, আখড়াই, টপ্পা প্রভৃতি ছিল মধ্যযুগ ও উনিশ শতকের সন্ধিক্ষণের বাংলা কাব্যের অমূল্য সম্পদ। বিশেষত ভাগীরথী অঞ্চলে এসব কবিতার অসামান্য প্রভাব ছিল এবং কলকাতার ধনিক-বণিকরা ছিলেন এসবের প্রধান সমঝদার। এ সময়ের শ্রেষ্ঠ কবি নিধিরাম গুপ্তের (নিধুবাবু) প্রণয়-কবিতার সঙ্গে আধুনিক গীতিকাব্যের একটা আন্তর সাদৃশ্য রয়েছে। তাছাড়া যাত্রা, পাঁচালি ও কবিগানের সঙ্গেও পরবর্তীকালের গীতিকাব্যের একটা সম্বন্ধ রয়েছে। এসব গান কেবল লোকমনোরঞ্জনের জন্যই রচিত ও পরিবেশিত হতো, তাই সাহিত্য হিসেবে এগুলি উঁচু মানের নয়। তবে এগুলিকে অনেকটা মার্জিত করেন গোঁজলা গুঁই ও অন্যরা। এক সময় তরজা-পাঁচালি-প্রিয় শহরবাসীদের মধ্যে কবিগানের সমাদর বাড়ে। আর এ পর্বের উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিরা হলেন ভোলা ময়রা, এন্টনি ফিরিঙ্গি, ঠাকুর সিংহ প্রমুখ।
আধুনিক গীতিকবিতা এ ধারার জনক বিহারীলাল চক্রবর্তী (১৮৩৫-১৮৯৪) সারদামঙ্গল (১৮৭৯) কাব্যের জন্য বিখ্যাত। তাঁর বঙ্গসুন্দরী (১৮৭০) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য এজন্য যে, এ্রতেই প্রথম রোম্যান্টিকতার বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। বিহারীলালের কাব্যের ভাষা সহজ ও স্বতঃস্ফূর্ত, কিন্তু ভাবের প্রগাঢ়তা এতে ক্ষুণ্ণ হয়নি। রবীন্দ্রনাথ তাঁর রচনাদ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হন। এ সময়ের অন্যান্য কবির মধ্যে সুরেন্দ্রনাথ মজুমদার (১৮৩৮-১৮৭৮) মহিলা কাব্য লিখে যশস্বী হন। দীনেশচরণ বসু প্রাঞ্জল ও সুমিষ্ট গীতিকবিতার জন্য খ্যাত। যোগীন্দ্রনাথ বসু স্বদেশপ্রীতিমূলক কাব্য রচনা করেন। দেবেন্দ্রনাথ সেনের কবিতায় ছিল ভাবুকতার উচ্ছ্বাস; তাঁর ভাষা সরল ও সুললিত এবং রচনার একটা প্রধান অংশ ফুল সম্পর্কীয়। অক্ষয়কুমার বড়ালের (১৮৬০-১৯১৯) কাব্য স্বকীয় বৈশিষ্ট্যমন্ডিত। তাঁর বিখ্যাত কাব্য এষা। রজনীকান্ত সেন (১৮৬৫-১৯১০) ছিলেন সরল ও সরস গীতিকবিতা এবং ব্যঙ্গকবিতা রচনায় সিদ্ধহস্ত। গোবিন্দদাস (১৮৫৪-১৯১৮) এ যুগের একজন প্রসিদ্ধ স্বভাবকবি। গিরীন্দ্রমোহিনী দাস (১৮৫৭-১৯২৪) ভাবগূঢ় গীতিকবিতা রচনা করেন। কামিনী রায় (১৮৬৪-১৯৩৩) ছিলেন উনিশ শতকের শ্রেষ্ঠ মহিলা কবি; তাঁর কবিতায় আন্তরিকতা ও বিষাদের সুর ধ্বনিত। মধুসূদনের ভ্রাতুষ্পুত্রী মানকুমারী বসুর কবিতায় ভগবদ্ভক্তি ও করুণরস পরিস্ফুট। এছাড়া এ যুগে আরও বহু কবি কাব্য-সাধনায় খ্যাতি অর্জন করেন, যেমন: আনন্দচন্দ্র মিত্র, গোবিন্দচন্দ্র রায়, বরদাচরণ মিত্র, নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলাল রায় (১৮৬৩-১৯১৩) প্রমুখ।
এ যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি ছিলেন কায়কোবাদ। হেমচন্দ্র-নবীনচন্দ্রের কাব্যধারায় মহাশ্মশান মহাকাব্য রচনা করে তিনি বিখ্যাত হন। মুসলমানদের তৎকালীন দুরবস্থা কবিকে বেদনার্ত করেছে, তাই তিনি তাদের সমৃদ্ধ অতীত অবলম্বনে কাব্য রচনা করেন। মহাশ্মশান পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধের ঘটনা নিয়ে রচিত ৮৭০ পৃষ্ঠার বিপুলায়তন কাব্যগ্রন্থ। এখানে কবি ভারতের হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায়ের একটি চরম সংকটপূর্ণ অবস্থা আবেগপূর্ণ ভাষায় বর্ণনা করেন। গীতিকাব্য রচনায়ও কায়কোবাদের কৃতিত্ব রয়েছে; অশ্রুমালা তাঁর একটি বিখ্যাত গীতিকাব্য।
আধুনিক নাট্যসাহিত্য বাংলায় আধুনিক নাট্যসাহিত্য সৃষ্টি হয় পাশ্চাত্যের প্রভাবে। প্রথমে কেবল ধনিকসমাজের চিত্তবিনোদনের জন্যই নাটক রচিত ও অভিনীত হতো। তখন রামনারায়ণ তর্করত্নের (১৮২২-১৮৮৬) কুলীন-কুলসবর্বস্ব জাতীয় কৌতুকনাট্য বাংলার রঙ্গমঞ্চকে মুখরিত করত। পরে আবির্ভাব ঘটে আধুনিক নাট্যকার মধুসূদন দত্তের। বাংলা কাব্যে আধুনিকতার দ্বারোদ্ঘাটনের মতো বাংলা নাটকেও তিনি আধুনিকতাকে প্রতিষ্ঠিত করেন। বেলগাছিয়া থিয়েটারে মঞ্চস্থ রত্নাবলী নাটকে নাট্যগুণগত দুর্বলতা ও বাংলা ভাষায় নাটকের অভাব অনুভব করে তিনি নাটক লিখতে শুরু করেন। মহাভারতের শর্মিষ্ঠা-দেবযানী-যযাতির কাহিনী অবলম্বনে তিনি প্রথম রচনা করেন শর্মিষ্ঠা (১৮৫৯) নাটক। তাঁর দ্বিতীয় নাটক পদ্মাবতী রচিত হয় এর অব্যবহিত পরেই (১৮৬০)। এতে গ্রীক পুরাণের কাহিনীকে তিনি দেশীয় ধারায় রূপদান করেন। পদ্মাবতী নাটক নানা কারণে উল্লেখলযোগ্য; শর্মিষ্ঠার তুলনায় এটি নাট্যগুণে অনেক সমৃদ্ধ এবং অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রথম প্রয়োগও হয় এ নাটকে।
মধুসূদনের একেই কি বলে সভ্যতা এবং বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ (১৮৬০) সমকালীন বাংলা সাহিত্যের দুখানি শ্রেষ্ঠ প্রহসন। এ দুটির অনন্যতা শুধু রচনাভঙ্গির জন্যই নয়, সমাজচেতনার বিশিষ্টতা ও ব্যাপকতার জন্যও। সংলাপ রচনায় চলিত ভাষাও গ্রাম্য ভাষার সার্থক ব্যবহার এবং ইংরেজি-ফারসিমিশ্রিত সংলাপে তিনি চরিত্রগুলিকে চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন। তবে মধুসূদনের শ্রেষ্ঠ নাটক কৃষ্ণকুমারী (১৮৬১) বাংলা ভাষায় রচিত প্রথম সার্থক ট্র্যাজেডি। প্রাচ্য নাট্যরীতি অগ্রাহ্য করে পাশ্চাত্য অলঙ্কারের নির্দেশ অনুযায়ী কবি কৃষ্ণকুমারীকে বিয়োগান্ত করেন। এ নাটকে স্বাদেশিকতার সুর বেজেছে। নাটকের ঘটনাসংস্থান, চরিত্রচিত্রণ ও সংলাপ রচনায় নাট্যকারের নৈপুণ্য প্রকাশ পেয়েছে।
মধুসূদনের অব্যবহিত পরেই নাট্যক্ষেত্রে অবতীর্ণ হন দীনবন্ধু মিত্র। প্রধানত এই দুজনের সাধনার ফলেই বাংলা নাটক প্রাথমিক পর্বের বিভিন্ন রকম দুর্বলতা ও অসঙ্গতি কাটিয়ে ওঠে। তাই বাংলা নাট্যসাহিত্যের ইতিহাসে মধুসূদন ও দীনবন্ধু অনন্য। দীনবন্ধুর শ্রেষ্ঠ নাটক নীলদর্পণ (১৮৬০)। এর ঐতিহাসিক মূল্য অপরিসীম। ইংরেজ নীলকররা অতিরিক্ত মুনাফার লোভে কীভাবে বাংলার কৃষকদের ওপর অত্যাচার চালিয়েছিল, তার মর্মন্তুদ চিত্র অঙ্কিত হয়েছে এই নাটকে। সেকালের সমাজজীবনে এই নাটকটি গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল। নীলচাষ বন্ধে নীলদর্পণের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। সমাজসচেতনতা দীনবন্ধু মিত্রের নাটকের বিশিষ্টতা।
অন্যান্য নাট্যকার মধুসূদন-দীনবন্ধুর পরে বাংলা নাটকে যাঁরা বিশেষ অবদান রাখেন তাঁরা হলেন মনোমোহন বসু (১৮৩১-১৯১২), গিরিশচন্দ্র ঘোষ (১৮৪৪-১৯১২), রাজকৃষ্ণ রায় (১৮৪৯-১৮৯৪), জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৪৯-১৯২৫), দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, গোলাম হোসেন প্রমুখ। মনোমোহন বসুর খ্যাতি অপেরা বা গীতাভিনয় রচনায়। তিনি পৌরাণিক উপাখ্যান অবলম্বনে সঙ্গীতপ্রধান দৃশ্যকাব্য রচনা করেন। এছাড়া তিনি কয়েকটি সামাজিক নাটকও লিখেছেন। রাজকৃষ্ণ রায় ছত্রিশটির মতো ছোট-বড় নাটক রচনা করেন; কিন্তু তাঁর প্রধান কৃতিত্ব মনোমোহন বসুর নাট্যধারাকে পরবর্তী নাট্যকার গিরিশচন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত করা। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী জ্যোতিরিন্দ্রনাথ বাংলা নাট্যসাহিত্যে বিশেষ অবদান রাখেন। তাঁর প্রধান চেষ্টা ছিল ফরাসি ও সংস্কৃত-মারাঠি ভাষার নাটক বাংলায় অনুবাদ করে বাংলা নাটককে সমৃদ্ধ করা। তাই তিনি কোনো বিশিষ্ট ধারা সৃষ্টি করতে না পারলেও তাঁর অনুবাদমূলক নাটকগুলি উল্লেখযোগ্য। তাঁর ইতিহাসাশ্রিত নাটকগুলিও উল্লেখ করার মতো।
প্রথম মুসলমান নাট্যকার গোলাম হোসেনের নাটক হাড়জ্বালানী মুদ্রিত হয় ১৮৬৪ সালে। এটি পূর্ণাঙ্গ নাটক নয়, নাট্যরীতিতে সংলাপের মাধ্যমে অঙ্কিত কয়েকটি সমাজচিত্র। মুসলমান রচিত গদ্য পুস্তকের প্রথম নিদর্শন হিসেবেই প্রধানত এর মূল্যায়ন করা হয়। প্রায় একই সময়ে রচিত আজিমদ্দীর কড়ির মাথায় বুড়োর বিয়ে একটি প্রহসন (২য় সংস্করণ ১৮৬৮)। গদ্যপদ্য মিশ্রিত ভাষায় রচিত প্রহসনটির তেমন কোনো বিশেষত্ব নেই। বাংলার খ্যাতিমান এবং প্রতিষ্ঠিত গদ্যশিল্পী মীর মশাররফ হোসেন একাধিক নাটক রচনা করেন। তাঁর প্রথম নাটক বসন্তকুমারী (১৮৭৩) সংস্কৃত নাটকের আঙ্গিকে রচিত। এ নাটকের সংলাপে কথ্য ভঙ্গির প্রয়োগ চরিত্রগুলিকে বাস্তবানুগ করেছে। তাঁর দ্বিতীয় নাটক জমিদারদর্পণে (১৮৭৩) সে সময়ের জমিদারদের অত্যাচারের কাহিনী চিত্রিত হয়েছে।
এ সময়ে বঙ্গদেশে যে নাট্যান্দোলন ঘটে, নানা কারণে তার শীর্ষে স্থান দেওয়া হয় গিরিশচন্দ্র ঘোষকে। তিনি ছিলেন তখনকার সর্বাপেক্ষা খ্যাতিমান নাট্যব্যক্তিত্ব। অসাধারণ অভিনয় ও নাট্য-পরিচালনার মাধ্যমে তিনি বাংলা নাটকে একটা ঐতিহ্য সৃষ্টি করেন। একের পর এক নাটক পরিবেশনের মাধ্যমে তিনি রঙ্গমঞ্চে প্রাণ সঞ্চার করেন। তিনি এ সত্য আবিষ্কার করেন যে, নাটক শুধু পাঠের জন্য নয়, বরং মঞ্চে অভিনীত হলেই তার সত্য প্রকাশিত হয়। গিরিশ ঘোষ সামাজিক, ঐতিহাসিক এবং পৌরাণিক বিষয় নিয়ে অনেক নাটক রচনা করেন। রঙ্গমঞ্চের প্রয়োজনেই তিনি বাংলা উপন্যাস ও আখ্যানকাব্যের নাট্যরূপ দিতে শুরু করেন। তিনি অনেক মৌলিক নাটকও রচনা করেন।
আধুনিক বাংলা নাটক যাত্রার ঢঙ পরিহার করেছিল, কিন্তু মনোমোহন বসু ও রাজকৃষ্ণ রায়ের চেষ্টায় তা আবার নাটকে স্থান লাভ করে এবং গিরিশচন্দ্র ঘোষ তা নিজের নাটকে গুরুত্বের সঙ্গে ব্যবহার করেন। তিনি প্রাচীন যাত্রারীতির সঙ্গে ইউরোপীয় নাটকের বহিরঙ্গের সমন্বয় ঘটাতে চেয়েছিলেন। তাঁর সে প্রচেষ্টা সফল না হলেও বাংলা নাটকে এক নতুনত্বের সৃষ্টি করে, যা তখনকার দর্শকচিত্ত আকর্ষণে সমর্থ হয়। গিরিশচন্দ্র পৌরাণিক নাটকের জন্যই সবচেয়ে বেশি খ্যাতি অর্জন করেন। তাঁর নাটকের সংখ্যাও সবচেয়ে বেশি এবং সমকালে ও পরবর্তী জনমানসে প্রভাব বিস্তারের দিক থেকে সেগুলি গুরুত্বপূর্ণ। গিরিশ ঘোষের সামাজিক নাটকে সমকালীন কলকাতার মধ্যবিত্ত জীবনের ছবি অঙ্কিত হয়েছে।
বাংলায় যথার্থ ঐতিহাসিক নাটক রচনার ধারা প্রবর্তন করেন দ্বিজেন্দ্রলাল রায়। তিনি সামাজিক ও পরিহাসমূলক নাটক রচনায়ও দক্ষতা দেখিয়েছেন। এর মূলে ছিল তাঁর ইউরোপ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা এবং ইউরোপীয় নাট্যসাহিত্যের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচয়। দ্বিজেন্দ্রলাল পৌরাণিক নাটকে আধুনিক মনোভাব নিয়ে আসতে চেয়েছিলেন। দ্বিজেন্দ্রলালের শ্রেষ্ঠ কীর্তি তাঁর ঐতিহাসিক নাটকগুলি। এগুলিতে ইতিহাসের সত্যতা প্রায়ই রক্ষিত হয়েছে। তাঁর মেবার পতন নাটকে জাতীয়তাবাদের ওপরে মানবমৈত্রীর আদর্শ স্থাপিত হয়েছে; আবার মুগল-জীবনের চিত্র অঙ্কিত হয়েছে তাঁর নূরজাহান (১৯০৮) এবং সাজাহান (১৯০৯) নাটকে। দ্বিজেন্দ্রলালের শ্রেষ্ঠ নাটক সাজাহান। এতে সাজাহান চরিত্রে পিতৃত্ব ও সম্রাটত্বের মধ্যে যে তীব্র অন্তর্দ্বন্দ্বের চিত্র তিনি এঁকেছেন তা বাংলা সাহিত্যে দুর্লভ। মঞ্চসাফল্যের দিক থেকেও সাজাহান বাংলা নাট্যমঞ্চের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত অপ্রতিদ্বন্দ্বী।
এ সময়ের আরও একজন উল্লেখযোগ্য নাট্যকার হলেন ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ (১৮৬৩-১৯২৭)। তিনি প্রায় অর্ধশত নাটক রচনা করে সমকালীন রঙ্গমঞ্চের চাহিদা মেটান। উন্নত নাট্যকলার অভাব সত্ত্বেও তাঁর নাটক যথেষ্ট জনপ্রিয়তা অর্জন করে। তাঁর নাটকের বিষয়বস্ত্ত ঐতিহাসিক, প্রণয়মূলক ও পৌরাণিক। আরবি-পারসিক লঘুরস ও রোমাঞ্চকর উপাখ্যান অবলম্বনে তিনি যেসব নাটক রচনা করেন, সেসব আনন্দ উপভোগের অকৃত্রিমতায় উত্তরকালেও ছিল প্রীতিপদ। যেমন, তাঁর অন্যতম বিখ্যাত রচনা আলিবাবা (১৮৯৭) সর্বসময়ের জন্য সমাদৃত বিনোদনমূলক একটি গীতিনাট্য। ক্ষীরোদপ্রসাদের কয়েকটি ঐতিহাসিক নাটক মঞ্চে যথেষ্ট সাফল্য লাভ করেছে।
১৮৬০-৭০ দশকে ইংরেজ রাজশক্তি ফরায়েজী, ওহাবী প্রভৃতি ধর্মীয় ও রাজনৈতিক আন্দোলন কঠোরভাবে দমন করলে পরবর্তী ২০-২৫ বছর বঙ্গদেশে অনুরূপ আন্দোলন আর দেখা যায় নি। এক সময় খ্রিস্টধর্ম মুসলমানদের ধর্ম ও সংস্কৃতির ওপর আঘাত হানে। শতাব্দী শেষে এর প্রতিকারে অবতীর্ণ হন মুনশি মেহেরুল্ললাহ (১৮৬১-১৯০৭) এবং তাঁর শিষ্য মুনশি মোহাম্মদ জমিরউদ্দীন (১৮৭০-১৯৩০)। আর এঁদেরই আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে সে যুগের মুসলমান বাঙালিকে সাহিত্যিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে স্বজাতি-অভিমুখী করে তোলে একটি বিশেষ দল ‘সুধাকর’, যার প্রধান ছিলেন মৌলবি মেয়রাজউদ্দীন আহম্মদ, পন্ডিত রেয়াজুদ্দীন আহমদ মাশহাদী, মুনশি শেখ আবদুর রহিম (১৮৫৯-১৯৩১) এবং মুনশি মোহাম্মদ রেয়াজুদ্দীন আহমদ। এঁরা ইসলামি ঐতিহ্য এবং জাতীয় ইতিহাস সম্বন্ধে মুসলমানদের সচেতন করে তোলার জন্য মাতৃভাষা বাংলায় সাহিত্য সৃষ্টি করেন এবং সংবাদপত্রাদির মাধ্যমে ধর্ম ও কৃষ্টিমূলক বিষয়বস্ত্তর প্রচার-প্রসারের জন্য কিছু বইয়ের অনুবাদ প্রকাশ করে সাহিত্যক্ষেত্রে এক পৃথক ধারার সূত্রপাত করেন। তাঁদের প্রথম প্রকাশনা হচ্ছে এসলাম তত্ত্ব। পরে শেখ আবদুর রহিম ও মুনশি মোহাম্মদ রেয়াজুদ্দীন আহমদ সুধাকর নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করেন (১৮৮৯)। যদিও সুধাকর-দলের আগেও বাংলা সাহিত্য সৃষ্টির পথে মুসলমান বাঙালিদের কেউ কেউ অগ্রসর হয়েছিলেন, কিন্তু বাংলায় মুসলমানদের জাতীয় সাহিত্য সৃষ্টির প্রচেষ্টা এঁদের আগে আর কেউ করেননি; স্বজাতীয়তাবোধও এমনভাবে বাংলা সাহিত্যে ফুটে ওঠেনি। এক কথায় সুধাকর-দলই মুসলমানদের জাতীয় সাহিত্যের ভিত্তি রচনা করে। এঁদের রচিত সাহিত্যের মূল্য যেমনই হোক, পরিপ্রেক্ষিত বিচারে বাংলা সাহিত্যে তার গুরুত্ব অপরিসীম।
মুনশি মোহাম্মদ মেহেরুল্ললাহর সুপ্ত প্রতিভার জাগরণ ঘটে খ্রিস্টান ধর্মের সঙ্গে প্রবল সংঘর্ষের ফলে। তাঁর নয়টি গ্রন্থের মধ্যে সাহিত্যিক বিচারে মেহেরুল এসলাম উল্লেখ্য এ কারণে যে, পুথির আদর্শে লিখিত এর গোড়াতে রসুলে করিম (স.)-এর নাত (স্ত্ততি) আছে, যা পরবর্তী বহুকাল যাবৎ দরুদশরিফের মতো আবৃত্ত হতো। এর ভাষা অত্যন্ত সহজ ও লালিত্যময়। মুনশি মোহাম্মদ জমিরউদ্দীন প্রথমে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হয়ে পাদ্রি জন জমিরউদ্দীন নামে পরিচিত হন। পরে ধর্মবিষয়ক বাদানুবাদে পরাজিত হয়ে তিনি পুনরায় মেহেরুল্ললাহর নিকট ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন এবং মুনশি জমিরউদ্দীন নাম নিয়ে ইসলাম প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন। মূলত ইসলাম প্রচার ও তার সেবাতেই তাঁর লেখনী সক্রিয় ছিল এবং এতেই তিনি খ্যাতি অর্জন করেন। শেখ আবদুর রহিম বাংলা ভাষার মাধ্যমে যেভাবে বাঙালি মুসলমানদের ঐতিহ্য সন্ধান এবং মানব সভ্যতায় ইসলামের অবদান তুলে ধরার চেষ্টা করেন, তেমনিভাবে আর কেউ করেননি। তাঁর প্রথম গ্রন্থ হজরত মহাম্মদের জীবনচরিত ও ধর্মনীতি (১৮৮৭) তাঁর শ্রেষ্ঠ কীর্তি। তিনি সুধাকর, মিহির, হাফেজ, মোসলেম প্রতিভা, মোসলেম হিতৈষী প্রভৃতি পত্রিকা সম্পাদনার সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। মোহাম্মদী পত্রিকায় তিনি যেসব প্রবন্ধ লেখেন তা থেকে সেকালের মুসলিম বাংলা সাহিত্য ও সাহিত্যিকদের সম্পর্কে একটা স্বচ্ছ ধারণা পাওয়া যায়। মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী ছিলেন একাধারে রাজনৈতিক কর্মী, সমাজসেবক, সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও সুবক্তা। তিনি প্রধানত ইতিহাসমূলক রচনার জন্যই খ্যাতি লাভ করেন। ভারতে মুসলমান সভ্যতা তাঁর শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকীর্তি। তিনি মিহির ও সুধাকরে লিখে সাহিত্যিক খ্যাতি অর্জন করেন এবং পরে সোলতান ও আমীর পত্রিকা সম্পাদনা ও প্রকাশ করেন। মুসলিম জাতির হূতগৌরব ফিরে পাওয়ার চিন্তাই ছিল তাঁর সাহিত্যসাধনার মূল প্রেরণা।
আরো কয়েকজন বিশিষ্ট মুসলমান লেখক হচ্ছেন: দীন মোহাম্মদ গঙ্গোপাধ্যায় (১৮৫৩-১৯১৬), মুনশি আবদুল লতিফ (১৮৭০-১৯৩৬), শেখ আব্দুল জববার (১৮৮১-১৯১৮), এয়াকুব আলী চৌধুরী (১৮৮৮-১৯৪০), কাজী আকরম হোসেন (১৮৯৬-১৯৬৩) প্রমুখ। বিভাগপূর্ব বাংলার একজন কংগ্রেসভক্ত জাতীয়তাবাদী নেতা হয়েও ইসলাম ও মুসলমানদের সেবায় সাহিত্যচর্চা করে আবদুল লতিফ খ্যাতি অর্জন করেন। ইসলামের ইতিহাস (১৯২৪) গ্রন্থটি রচনা করে সুবিখ্যাত হলেও কাজী আকরম হোসেন সাহিত্যের অন্যান্য ক্ষেত্রেও যথেষ্ট অবদান রাখেন। এয়াকুব আলী চৌধুরীর মতো পন্ডিত সাহিত্যিক ওই সময়ে বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে কমই ছিল। তাঁর দার্শনিক চিন্তাশীলতার প্রকৃষ্ট উদাহরণ মানব মুকুট। এ গ্রন্থে নবী মুহাম্মাদ (সঃ)-এর জীবনী ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তাঁর ভাষা হয়ে উঠেছে অপূর্ব ধ্বনিব্যঞ্জনাময়।
রবীন্দ্রপর্ব বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। রবীন্দ্রনাথ বাংলা সাহিত্যের সকল ক্ষেত্রেই অনন্যসাধারণ অবদান রেখেছেন। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে তিনিই বিশ্বসাহিত্যের মর্যাদায় ভূষিত করেন। তাঁর পরিচয় যদিও ‘বিশ্বকবি’ হিসেবেই, তথাপি এ কথা অনস্বীকার্য যে, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে আজ পর্যন্ত শ্রেষ্ঠ গদ্য লেখকের কৃতিত্ব তাঁরই। তাঁর সৃষ্টিকাল উনিশ শতকের শেষভাগ থেকে আমৃত্যু (৭ আগস্ট ১৯৪১) বিস্তৃত। বিশ শতকের একটা বড় অংশ জুড়ে তিনি ছিলেন বাংলা সাহিত্যের একচ্ছত্র অধিপতি।
রবীন্দ্রনাথের ভাবানুভূতি ও শিল্পচেতনা বিবর্তনধর্মী। সৃজনশীলতা, নব নব ভাবকল্পনা ও রূপচেতনার দ্বারা তিনি একটি স্বতন্ত্র ধারার সৃষ্টি করেন। তিনি অভূতপূর্ব শিল্পসমৃদ্ধ ও নতুন রূপাঙ্গিকের কাব্য, নাটক, উপন্যাস, ছোটগ্রল্প, প্রবন্ধ এবং দুহাজারেরও অধিক গান রচনা করেছেন। তবে এগুলিই সাহিত্যের ইতিহাসে তাঁকে মূল্যায়িত করার জন্য যথেষ্ট নয়। সাহিত্য, সমাজ, ধর্ম ও রাজনীতিবিষয়ক তাঁর বিবিধ প্রবন্ধ, সামাজিক ও ধর্মীয় বিশ্লেষক হিসেবে তাঁর অবদান, বিভিন্ন রচনার স্বকৃত ইংরেজি অনুবাদ সব মিলিয়ে প্রাচুর্যে ও বৈচিত্র্যে রবীন্দ্রনাথ একটি পূর্ণ প্রতিষ্ঠানস্বরূপ। তাঁর রচনা পৃথিবীর প্রধান প্রধান ভাষায় অনূদিত হয়েছে। কবি হিসেবে তিনি বিশ্বজোড়া খ্যাতি অর্জন করেন গীতাঞ্জলি কাব্যের জন্য নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির মাধ্যমে। রবীন্দ্রযুগ বাংলা সাহিত্যের সমৃদ্ধির সেরা যুগ। এ পর্বের সাহিত্যের প্রধান বিশেষত্ব কাব্য-সাহিত্যের নতুন ভাব-ভঙ্গি ও আদর্শ, কথা-সাহিত্যের অসামান্য বিকাশ ও উন্নতি, নাট্যসাহিত্যে আধুনিক ব্যক্তিচৈতন্য, সমাজবোধ ও অধ্যাত্মবোধের প্রকাশ, পাশ্চাত্য সাহিত্যের আদর্শ স্বীকরণ, চলিত ভাষার প্রভাব, সাময়িকপত্রের প্রকাশ ও তার মাধ্যমে সাহিত্যের দ্রুত উন্নতি এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বাংলার পঠন-পাঠন ও বাংলায় পাঠ্যপুস্তক রচনার প্রসার।
এ পর্বের দুজন উল্লেখযোগ্য সাহিত্যিক হচ্ছেন জগদীশচন্দ্র বসু (১৮৫৮-১৯৩৭) ও রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী (১৮৬৪-১৯১৯)। বাংলার খ্যাতনামা বৈজ্ঞানিক জগদীশচন্দ্র Response of the living and the non-living নামে যে গ্রন্থটি লিখে বিশ্বজোড়া খ্যাতি অর্জন করেন, তারই বাংলা রূপ তাঁর অব্যক্ত গ্রন্থ। জড় জগতের মধ্যে যে চেতন সত্তার আবিষ্কার তিনি করেছিলেন, তার বর্ণনায় জগদীশচন্দ্রের কবিদৃষ্টির পরিচয় পাওয়া যায়। রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর ছিল সর্ববিষয়ে অনুসন্ধিৎসু মন। তবে বিজ্ঞানবিষয়ক রচনায়ই তিনি বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। বেদ, মহাভারত ও মহাজনচরিতকথাসহ বাংলার মেয়েলি ছড়া পর্যন্ত সকল বিষয়েই তাঁর মনীষার পরিচয় পাওয়া যায়।
রবীন্দ্রযুগের সবচেয়ে জনপ্রিয় সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৭৬-১৯৩৮)। কথাসাহিত্যিক হিসেবে তিনি ছিলেন অসাধারণ। তাঁর সামাজিক উপন্যাসের জনপ্রিয়তা সে যুগের মতো এ যুগেও এমনভাবে বহমান যে, ভারতীয় প্রায় সব ভাষায় সেগুলি অনূদিত, এমনকি চলচ্চিত্র ও মঞ্চনাটকেও রূপান্তরিত হয়েছে। তাঁর রচনায় বাঙালির নিত্যদিনের সুখদুঃখময় জীবনযাত্রা, বাংলার পল্লিলসমাজ এবং সর্বোপরি বাংলার নারীচরিত্র অপরূপ মাধুর্যে ফুটে উঠেছে। সমাজের অন্যায়, অবিচার ও দুর্বলতা তিনি তীক্ষ্ণ ও যুক্তিপূর্ণ ভাষায় পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন। ভাষায় আবেগ সঞ্চারে এবং বাংলা গদ্যের ক্রমবিকাশে শরৎচন্দ্রের অবদান নজিরবিহীন। সামাজিক সংস্কার ও নীতিবোধের প্রশ্নকেই তিনি তাঁর উপন্যাসের উপজীব্যরূপে তুলে ধরেছেন।
প্রমথ চৌধুরী (১৮৬৮-১৯৪৬) রবীন্দ্রনাথের বয়ঃকনিষ্ঠ হয়েও গদ্য রচনারীতিতে তাঁকে প্রভাবিত করেন। তাঁর প্রবন্ধ এবং ভাষাভঙ্গি পরবর্তী একটি গোষ্ঠীর ওপর বিশেষ ক্রিয়াশীল ছিল। তাই রবীন্দ্রযুগের লেখক হয়েও বাংলা গদ্যের একটা স্বতন্ত্র ধারা প্রতিষ্ঠার দাবিদার হিসেবে প্রমথ চৌধুরী বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে বিশেষভাবে খ্যাত। বাংলায় কথ্যরীতি তাঁরই হাতে সাহিত্যিক স্বীকৃতি লাভ করে এবং রবীন্দ্রনাথের সমর্থন ও চর্চায় তা সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলায় ফরাসি ছোটগল্পের আঙ্গিকরীতিকে তিনিই প্রথম পরিচিত করেন।
প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় (১৮৭৩-১৯৩২) অনেকগুলি উপন্যাস লিখলেও তাঁর আসল পরিচয় পাওয়া যায় তাঁর শতাধিক ছোটগল্পে। তাঁর ছোটগল্পের আঙ্গিকনৈপুণ্য উল্লেখ করার মতো। গল্পের শেষে একটি আকস্মিক চমক তাঁর রচনাকে বিশিষ্টতা দান করেছে। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৭১-১৯৫১) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য বাংলা গদ্যের কথ্যরীতির অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক হিসেবে। তাঁর এ রীতির পরিচয় পাওয়া যায় তাঁর আত্মজীবনীমূলক রচনায় এবং শিল্পের সৌন্দর্যতত্ত্বের বর্ণনায়। এ পর্বের আরও উল্লেখযোগ্যরা হলেন নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত, উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়, কেদারনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় (হাস্যরসিক), খগেন্দ্রনাথ মিত্র, জগদীশচন্দ্র গুপ্ত, জলধর সেন, সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়, নিরুপমা দেবী, প্রভাবতী দেবী, সীতা দেবী, শান্তা দেবী, হেমেন্দ্রকুমার রায় প্রমুখ।
রবীন্দ্রবলয়ে বাংলা কবিতা অর্ধশতাব্দীরও অধিককাল যাবৎ রবীন্দ্রযুগের কবিগণ রবীন্দ্রনাথের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। তবে কয়েকজন কবি এ প্রভাব অতিক্রম করে স্বাতন্ত্র্য সৃষ্টিতে সফল হয়েছেন। এমন চারজন প্রধান কবি হলেন সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত (১৮৮২-১৯২২), মোহিতলাল মজুমদার (১৮৮৮-১৯৫২), কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬) এবং জসীমউদ্দীন (১৯০২-১৯৭৬)। সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত নতুন নতুন ছন্দ নির্মাণের ক্ষেত্রে অসাধারণ পারদর্শিতা দেখিয়েছেন; তাই তাঁকে বলা হয় ‘ছন্দের জাদুকর’। শব্দের চমৎকার ব্যবহার এবং ধ্বনির অনুরণন দিয়ে তিনি এক মায়াজাল বিস্তার করতেন। সত্যেন্দ্রনাথ কবিতার অনুবাদের ক্ষেত্রেও প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন।
মোহিতলাল মজুমদার ভাবকল্পনা ও প্রেম সম্পর্কে নবতাৎপর্য আবিষ্কারে এবং রবীন্দ্রোত্তর কাব্যে আধুনিকতার দ্বারোদ্ঘাটনে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তাঁর দেহবাদী চেতনা অশরীরী প্রেমানুভূতিকে অস্বীকার করেছে। তবে বাগ্ভঙ্গি ও কবিতার দেহগঠনে তাঁর আদর্শ ক্লাসিক। নজরুল ইসলাম রবীন্দ্রনাথের শান্তস্নিগ্ধ কাব্যপরিমন্ডলে ধূমকেতুর মতো আবির্ভূত হয়েছিলেন। সাহিত্য ও সমাজে তিনি নিয়ে আসেন বিদ্রোহ। যে ‘বিদ্রোহী’ কবিতার মাধ্যমে নজরুলের বাংলা কাব্যক্ষেত্রে আগমন, সে কবিতাই তাঁর স্থায়ী প্রতিষ্ঠার কারণ। বাংলা সাহিত্যে বীররসের কবিতা প্রবর্তনের কৃতিত্ব একা নজরুলের। তাঁর কাব্যের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য সমসাময়িকতা। সাময়িক ঘটনা এবং জীবন বা আবেগকে অবলম্বন করে তাঁর মতো এত প্রচুর আর কেউ লেখেননি। তিনি একই সঙ্গে কবিতা লিখেছেন, প্রচারমূলক প্রবন্ধ লিখেছেন এবং সংবাদপত্রও পরিচালনা করেছেন। তাঁর অগ্নি-বীণা ও বিষের বাঁশি গ্রন্থদুটিতে দুস্থ মানবতার জয় ঘোষণা করতে গিয়ে ইংরেজ রাজশক্তির বিরুদ্ধে যে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ প্রকাশ পেয়েছে, তা তখন এ দেশ ও সমাজ কামনা করেছিল। ১৯৩০-এর পর থেকে নজরুল খ্যাত হয়ে ওঠেন গীতিরচয়িতা ও সুরকার হিসেবে। তাঁর গজল গানগুলি কবিতা হিসেবেও যথেষ্ট গুরুত্ব পেয়েছে। বাংলা গানের জগতে রবীন্দ্রসঙ্গীতের পাশাপাশি নজরুলসঙ্গীতও স্বাতন্ত্র্যমন্ডিত ও বাঙালি সংস্কৃতির শাশ্বত সম্পদ।
জসীমউদ্দীন রবীন্দ্রযুগের হয়েও ভিন্নতর কাব্যচেতনার কারণে স্বাতন্ত্র্য অর্জন করেন। তাঁর কবিতায় গ্রামবাংলার ঐতিহ্য প্রাধান্য পাওয়ায় তিনি ‘পল্লিকবি’ উপাধিতে ভূষিত হন। অত্যন্ত সফলভাবে তিনি গ্রামজীবন ও গ্রামবাংলার পরিবেশকে কাব্য ও নাটকে উপাদান হিসেবে ব্যবহার করেন। বিষয় গ্রামীণ হলেও কাব্যের রূপশিল্পে জসীমউদ্দীন সম্পূর্ণ আধুনিক। রবীন্দ্রযুগের অন্যান্য উল্লেলখযোগ্য কবি হলেন করুণানিধান বন্দ্যোপাধ্যায়, চিত্তরঞ্জন দাশ, অতুলপ্রসাদ সেন, কালিদাস রায়, কুমুদরঞ্জন মল্লিক, নরেন্দ্র দেব, প্রথমনাথ রায়চৌধুরী, বিজয়চন্দ্র মজুমদার, মানকুমারী বসু, যতীন্দ্রমোহন বাগচী, যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত, সাবিত্রীপ্রসন্ন চট্টোপাধ্যায়, রাধারাণী দেবী, উমাদেবী প্রমুখ।
রবীন্দ্রপর্বের প্রবন্ধসাহিত্য এ পর্বের প্রাবন্ধিকগণ রবীন্দ্রনাথের দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত। এ সময়ে বিষয়ের গভীরতা এবং ভাষা ও বাচনভঙ্গির সৌকর্যে বেশ কয়েকজন প্রাবন্ধিক সাফল্যের পরিচয় দেন। ইতিহাস, দর্শন, সাহিত্য ও সংস্কৃতিবিষয়ক আলোচনায় প্রবন্ধের ভান্ডার এ সময়ে পূর্ণ হয়ে ওঠে, তবে বিজ্ঞান ও রাজনীতিবিষয়ক প্রবন্ধ-সাহিত্যের অভাব ছিল।
এ পর্বের প্রাবন্ধিকদের মধ্যে প্রথমেই উল্লেলখযোগ্য প্রমথ চৌধুরী। সবুজপত্রকে কেন্দ্র করে তিনি বাংলা গদ্যে নবরীতি প্রবর্তন করেন এবং তাঁর প্রবন্ধাবলিতে প্রমাণ করেন যে, চলিত ভাষায় লঘুগুরু সকল প্রকার ভাব প্রকাশ করা সম্ভব। দর্শন, রাজনীতি, ভাষা, সাহিত্য, ইতিহাস ইত্যাদি বিষয়ে তিনি যে প্রবন্ধগুলি রচনা করেন, সেগুলির সর্বত্রই তাঁর পান্ডিত্যের প্রকাশ ঘটেছে। সাহিত্যসমালোচক হিসেবেও তিনি বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী প্রধানত বিজ্ঞানবিষয়ক প্রবন্ধ রচনায় খ্যাতি লাভ করলেও শব্দতত্ত্ব ও ব্যাকরণ, সমাজ ও রাজনীতি এবং দর্শনবিষয়ক প্রবন্ধ রচনায়ও তাঁর খ্যাতি আছে। তাঁর দার্শনিক প্রবন্ধগুলি চিন্তার গভীরতায়, যুক্তি, পদ্ধতি ও সিদ্ধান্তের মৌলিকতায় এবং সর্বোপরি ভাষার সরলতায় বাংলা সাহিত্যে অতুলনীয়।
বলেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৭০-১৯০০) সাহিত্য সমালোচনামূলক প্রবন্ধ রচনায় দক্ষতা দেখিয়েছেন। এ ব্যাপারে তিনি রবীন্দ্রনাথের দ্বারা প্রভাবিত হলেও তাঁর মৌলিক অবদানও অনস্বীকার্য। তিনি সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন বৈষ্ণব কবিতার বিচারে। আধ্যাত্মিক তাৎপর্যকে গুরুত্ব না দিয়ে তিনি কেবল সেগুলির সাহিত্যসৌন্দর্যকেই আলোচনার বিষয়ীভূত করেছেন। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিল্প সম্পর্কে উন্নত মানের তাত্ত্বিক আলোচনায় পারদর্শী ছিলেন। তিনি তাঁর বাগেশ্বরী শিল্প প্রবন্ধাবলী এবং বাংলার ব্রত গ্রন্থে যে গদ্য ব্যবহার করেছেন তা চলিত ভাষারীতি, চিত্রাঙ্কন পদ্ধতি এবং কাব্যধর্মের এক বিচিত্র মিশ্রণ হয়ে উঠেছে। বাংলা গদ্যরীতি তাঁর হাতে এক ভিন্ন মাত্রা লাভ করেছে। মোহিতলাল মজুমদার ছিলেন বাংলা সমালোচনা সাহিত্যের এক উল্লেললখযোগ্য ব্যক্তিত্ব। মননে ও সাহিত্যে তিনি উচ্চতর আদর্শের পরিচয় দেন। তাই তাঁর বাক্রীতিতে উনিশ শতকীয় গাম্ভীর্য এবং শব্দাড়ম্বর প্রাধান্য পায়। সমালোচনা রীতিতে তিনি কিছুটা বঙ্কিমী হলেও রবীন্দ্রযুগের সৌন্দর্যরুচি তাঁর মধ্যে ছিল। এ যুগের উল্লেখযোগ্য আরও কয়েকজন প্রাবন্ধিক হলেন দীনেশচন্দ্র সেন, সুরেশচন্দ্র সমাজপতি, পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়, শশাঙ্কমোহন সেন প্রমুখ।
রবীন্দ্রপর্বের নাট্যধারা বাংলা সাহিত্যের অন্যান্য ধারায় রবীন্দ্রপ্রভাব যতটা গভীরতর হয়েছিল, নাটকের ক্ষেত্রে ততটা নয়। সমকালীন এবং অনুজ নাট্যকাররা তাঁর দ্বারা ততটা প্রভাবিত হননি, বরং গিরিশ-দ্বিজেন্দ্রের মঞ্চানুগ ধারাই তখন অধিক প্রচলিত ছিল। রবীন্দ্রনাটক কোন বিদেশী ধারার ব্যর্থ অনুকরণমাত্র না হয়ে এক স্বতন্ত্র সৃষ্টি হয়ে উঠেছিল, কিন্তু যোগ্য উত্তরসূরির অভাবে সে ধারার পরিপুষ্টি হয়নি।
রবীন্দ্রোত্তর পর্ব বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে সংঘটিত প্রথম মহাযুদ্ধ এবং সমাজতান্ত্রিক রুশ বিপ্ললবের প্রভাবে বঙ্গদেশে যে সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী আন্দোলন শুরু হয়, তার ফলে বাংলা সাহিত্যের ধারা নতুন দিকে মোড় নেয়। ১৯৩০-এর কাছাকাছি সময় থেকে বাংলা সাহিত্য নবপর্বে প্রবেশ করতে থাকে। এ সময় গল্প, উপন্যাস এবং কবিতার ক্ষেত্রে বেশ কয়েকজন বড় সাহিত্যিকের আবির্ভাব ঘটে। কলকাতায় প্রকাশিত হয় কল্লোল (১৯২৩) নামে একটি পত্রিকা। এর শাখা-পত্রিকা হিসেবে কলকাতায় প্রকাশিত হয় কালিকলম (১৯২৬) এবং ঢাকায় প্রকাশিত হয় প্রগতি (১৯২৭)। এসব পত্রিকার মাধ্যমে উপর্যুক্ত গোষ্ঠীর সাহিত্যচর্চা চলতে থাকে। শনিবারের চিঠিও প্রকারান্তরে তাঁদের উৎসাহ যোগায়। কল্লোল-কালিকলম-প্রগতি গোষ্ঠী মূলত রবীন্দ্র-ঐতিহ্যের সৃষ্টি হলেও পরের দিকে তাঁরা এ প্রভাব অতিক্রম করায় সচেষ্ট হন এবং শরৎচন্দ্র ও নজরুল তাঁদের নিকট প্রাধান্য পান। রবীন্দ্রসাহিত্য ধারার এই ব্যতিক্রমকাল বলা চলে ১৯১৮ থেকে ১৯৩৮ পর্যন্ত নজরুলও এ সময়েরই কবি। কল্লোল যুগের ব্যতিক্রমধর্মী লেখকদের মধ্যে আরও খ্যাতিমান ছিলেন বুদ্ধদেব বসু, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত প্রমুখ। এঁদের লেখায় বাংলা সাহিত্যে নতুন প্রত্যাশার সঞ্চার হয়।
তিরিশের সাহিত্যধারা উপন্যাস ও ছোটগল্প এ সময় কয়েকজন বড় সাহিত্যিকের আবির্ভাবে বাংলা উপন্যাস ও ছোটগল্প বিচিত্রমুখী হয়ে ওঠে। শ্রমজীবী মানুষের জীবনকাহিনী, সমস্যাসঙ্কুল মানবজীবন, ভারতবর্ষের রাজনীতি, সমাজনীতি প্রভৃতিকে বিষয় হিসেবে নিয়ে এ পর্বের লেখকরা ছোটগল্পে বৈচিত্র্য আনয়ন করেন। রাজশেখর বসু (১৮৮০-১৯৬০) ছিলেন তাঁদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। তিনি বাংলা ব্যঙ্গ গল্পধারার প্রধান শিল্পী। তাঁর প্রথম দিকের গল্পগুলি রঙ্গ-ব্যঙ্গ ও সাময়িকের সঙ্গে শাশ্বত জীবনচেতনার সংমিশ্রণে উচ্চ মর্যাদা লাভ করেছে।
তিরিশের কালে বাংলা উপন্যাসে যাঁরা খ্যাতি অর্জন করেন তাঁদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্যদের একজন হলেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৪-১৯৫০)। পল্লিপ্রধান বাংলার গার্হস্থ্য জীবন ও পল্লিপ্রকৃতির অপূর্ব কাব্যিক বর্ণনা তাঁর রচনার বিশেষত্ব। প্রকৃতির শান্তস্নিগ্ধ ও মমতাভরা রূপ বর্ণনার মাধ্যমে মানবপ্রকৃতির বিশ্লেষণ তাঁর রচনায় প্রধান হয়ে উঠেছে। তাঁর শ্রেষ্ঠ রচনা পথের পাঁচালী (১৯২৯)।
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৮-১৯৭১) তৎকালীন উপন্যাস-সাহিত্যে এক শক্তিধর প্রতিভা। বাংলার পল্লী অঞ্চলের সহজ-সরল কৃষক, মাঝি ও গায়েনের প্রাণের মূল্য তিনি অপরিসীম দরদের সঙ্গে উপলব্ধি করেন। রাঢ়ের রুক্ষভূমির স্পর্শ, শ্রমজীবী মানুষের কাহিনী বর্ণন এবং সুতীব্র আত্মানুসন্ধান তাঁর উপন্যাসকে দুর্লভ শিল্পোৎকর্ষ দিয়েছে। তাঁর গণদেবতা (১৯৪২) ও পঞ্চগ্রাম (১৯৪৪) উপন্যাস দুটিতে পল্লিজীবনের বৈচিত্র্যমন্ডিত কাহিনী মূর্ত হয়ে উঠেছে। তাই বৈচিত্র্য, বিশালতা এবং সামগ্রিকতায় এ দুটিকে বলা হয় পল্লিজীবনের মহাকাব্য। তাঁর গল্পের বিষয়বস্ত্তও পল্লিপ্রধান।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯০৮-১৯৫৬) বাংলা উপন্যাসের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে অন্যতম প্রধান ঔপন্যাসিক ও ছোটগল্পকার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। তাঁর মানবজীবনকে দেখার রীতি একান্ত নিজস্ব। মনোবিশ্লেষণের মাধ্যমে মানবজীবন ও মানবপ্রকৃতির গোপন রহস্য আবিষ্কার তাঁর রচনার আদর্শ। পুতুল নাচের ইতিকথা (১৯৩৬) ও পদ্মানদীর মাঝি (১৯৩৬) তাঁর সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য দুটি রচনা। এতে তাঁর মানসবৈশিষ্ট্য সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। তাঁর উত্তরজীবনের রচনায় মার্কসবাদী মতাদর্শ এবং দলীয় মতের তীব্র সমর্থন দেখা যায়। প্রেমেন্দ্র মিত্র (১৯০৪-১৯৮৮) প্রথম শ্রেণির ছোটগল্পকার ছিলেন। মিতভাষণ, বক্তব্যের সূক্ষ্মতা এবং চরিত্র সৃষ্টিতে তিনি পারদর্শী ছিলেন। মানুষের জীবনসংগ্রাম থেকে শুরু করে রাজনীতি, সমাজনীতি সবই তাঁর সাহিত্যে স্থান পেয়েছে।
এ যুগের শক্তিমান কথা-সাহিত্যিকদের আরও কয়েকজন হলেন জগদীশ গুপ্ত, বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায় (১৮৯৬-১৯৮৭), বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় (১৮৯৯-১৯৭৯), প্রমথনাথ বিশী (১৯০১-৮৫), মনোজ বসু (১৯০১-১৯৮৭), গোপাল হালদার (জ. ১৯০২), অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত (১৯০৩-১৯৭৬), অন্নদাশঙ্কর রায় (জ. ১৯০৪), প্রবোধকুমার সান্যাল (১৯০৫-১৯৮৩), বুদ্ধদেব বসু (১৯০৮-১৯৭৪), সুবোধ ঘোষ (১৯০৯-১৯৮০), গজেন্দ্রকুমার মিত্র (জ. ১৯০৯), বিমল মিত্র (জ. ১৯১২), নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় (১৯১৮-১৯৭০), মতি নন্দী (জ. ১৯৩১), শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় (১৯৩৩-২০০১), সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় (জ. ১৯৩৪), শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় (জ. ১৯৩৫) প্রমুখ।
কাব্যসাহিত্য প্রথম মহাযুদ্ধের পর ইউরোপীয় সমাজজীবনে যে ভাঙন ধরেছিল, ইংরেজি সাহিত্যের মাধ্যমে তার সর্বব্যাপী প্রভাব পড়েছিল বাঙালি কবিদের ওপরও। তাঁরা তখন বাংলা কবিতায় সৌন্দর্য, প্রেম ও আনন্দ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রভাবনাকে অস্বীকার করে পল্লিজীবনের চেয়ে নাগরিক জীবনকে বেশি প্রাধান্য দেন। এ সময়ের কাব্যসাহিত্যে অতি আধুনিকতা প্রবর্তনের প্রয়াসে অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, বুদ্ধদেব বসু ও প্রেমেন্দ্র মিত্র অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। সে সঙ্গে জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯-১৯৫৪), সুধীন্দ্রনাথ দত্ত (১৯০১-১৯৬০), বিষ্ণু দে (১৯০৯-১৯৮২) এবং সমর সেনের (জ. ১৯১৬) নামও উল্লেখযোগ্য। জীবনানন্দ দাশ এ পর্বের সবচেয়ে শক্তিমান কবি। কবিতার প্রকাশভঙ্গিতে তিনি বুদ্ধি ও বোধের দ্বারা তাড়িত হওয়ার চেষ্টা করেছেন। তাই তাঁর কবিতায় হূদয়ের সামগ্রিক আবেদন চিরকালীন। তাঁর কবিতাকে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন ‘চিত্ররূপময়’, কারণ তা পাঠকদৃষ্টিতে ছবির মতো ভেসে ওঠে। তিনি প্রধানত প্রকৃতির কবি; উপমা প্রয়োগের অভিনবত্ব তাঁর কাব্যের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য।
সুধীন্দ্রনাথ দত্ত ছিলেন একজন প্রগাঢ় ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, দর্শনমনস্ক ও বুদ্ধিনির্ভর কবি। তাঁর বাক্রীতির একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল। ভাবে ও ভাষায় তাঁর কবিতা দুরূহ। অপ্রচলিত শব্দ ব্যবহার তাঁর ভাষাকে করেছে জটিল। কিন্তু এই জটিলতা বাইরে থেকে আরোপিত একটা ফ্যাশনমাত্র নয়, কবির জীবনদৃষ্টিতেই নিহিত এই জটিলতার মূল। একদিকে ব্যক্তিগত প্রেমানুভূতি, অন্যদিকে বিশ্ববোধ, ইতিহাস ও সমাজচেতনা তাঁকে বিষণ্ণ-বেদনায় আহত করেছে প্রতিনিয়ত। এই যন্ত্রণাক্ষুব্ধ চিত্তই জটিল ভাষা ও দুরূহ শব্দে আত্মপ্রকাশ করেছে তাঁর কবিতায়। মার্কসীয় সমাজাদর্শ-ভাবুক বিষ্ণু দের কবিতা শব্দবিন্যাস, মিথ প্রযুক্তি ও ছন্দকৌশলের নতুনত্বের কারণে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য অর্জন করেছে। সমর সেন নগরজীবনের পরিবেশকে কবিতার উপজীব্য করেছেন; তবে তাঁর কাব্যে মার্কসীয় ভাবধারার পাশাপাশি রোম্যান্টিক চেতনা ও সাঁওতাল পরগনার শান্ত পরিবেশের মাধুর্যও রয়েছে।
বুদ্ধদেব বসু ছিলেন রবীন্দ্রধারার ব্যতিক্রমী কবিদের প্রথম সারির একজন। আধুনিক কবিতার বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে তিনি পুরোপুরি সচেতন ছিলেন। তাঁর কবিতার দেহ অতিমার্জিত এবং দুর্বোধ্যতা ও বাচনবক্রতা থেকে অনেকটাই মুক্ত। দেহকামনার রক্তরাগ সঞ্চারিত হয়েছে তাঁর প্রেমের কবিতায়। তাঁর বেশি বয়সের কবিতা থেকে বোঝা যায় যে, অন্তরের গভীরে তিনি ছিলেন মূলত রোম্যান্টিক কবি।
প্রেমেন্দ্র মিত্রের কবিতা ভাবের দিক থেকে বিদ্রোহের এবং নিপীড়িত ও বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর জন্য এক নতুন উপলব্ধি। তাতে যতটা আছে উচ্চকণ্ঠ আত্মঘোষণা, ততটা নেই জীবনজিজ্ঞাসার তীব্রতা ও গভীর আকুতি। তবে তাঁর কবিতায় মানবের আদি ও অকৃত্রিম জীবনপ্রবৃত্তির স্বীকৃতি রয়েছে। গভীর মানবতাবোধ প্রকাশের জন্য তাঁর কবিতা হয়েছে আবেদনময়ী। অমিয় চক্রবর্তী (১৯০১-১৯৮৬), সুকান্ত ভট্টাচার্য (১৯২৬-১৯৪৭), অজিত দত্ত, অরুণ মিত্র, সুভাষ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ এ যুগের আরও কয়েকজন উল্লেখযোগ্য কবি।
নাট্যসাহিত্য কাব্য ও কথাসাহিত্যের মতো এ পর্বের নাট্যসাহিত্যে আধুনিকতার প্রকাশ ততটা উল্লেখযোগ্য নয়। তখনও পর্যন্ত মোটামুটিভাবে গিরিশ-দ্বিজেন্দ্রলালের ধারাই অনুসৃত হয়েছে। তবে মঞ্চব্যবস্থার আধুনিকায়ন, নাট্যাঙ্গিকের পরিবর্তন, শিক্ষিত অপেশাদার নাট্যশিল্পীদের আগমন, নতুন ধরনের নাটক রচনা ইত্যাদি কারণে নাট্যসাহিত্যে রুচির পরিবর্তন ঘটেছে। এ পর্যায়ে যোগেশচন্দ্র চৌধুরী (১৮৮৬-১৯৪১), শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত (১৮৯২-১৯৬১), তুলসী লাহিড়ী (১৮৯৭-১৯৫৯), মন্মথ রায় (১৮৯৯-১৯৮৮), প্রথমনাথ বিশী প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।
প্রবন্ধসাহিত্য এ পর্বে বিষয়সমৃদ্ধ প্রবন্ধে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় (১৮৯০-১৯৭৭), সুশীলকুমার দে (১৮৯০-১৯৬৮), রাজশেখর বসু, নীহাররঞ্জন রায় (১৯০৩-১৯৮১), সুকুমার সেন; সমালোচনায় শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯২-১৯৭০), শশিভূষণ দাশগুপ্ত (১৯১১-১৯৬৪), প্রথমনাথ বিশী এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে অতুলচন্দ্র গুপ্ত (১৮৮৪-১৯৬১), অন্নদাশঙ্কর রায়, ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় (১৮৯৪-১৯৬১) প্রমুখ উল্লেলখযোগ্য। সৃজনধর্মী প্রবন্ধে বুদ্ধদেব বসু, সৈয়দ মুজতবা আলী (১৯০৪-১৯৭৪), হুমায়ুন কবির (১৯০৬-১৯৬৯), আবু সয়ীদ আইয়ুব (১৯০৬-১৯৮২) প্রমুখ উল্লেখযোগ্য কৃতিত্বের অধিকারী।
মুসলিম মানস উনিশ শতকের শেষার্ধ থেকে বিশ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত মুসলমান বাঙালিদের সাহিত্য-সাধনায় সমাজসংস্কারের চিন্তা-ভাবনা, জাতীয় ঐতিহ্য সম্পর্কে ধ্যান-ধারণা এবং আত্মপ্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টাই প্রধানরূপে প্রতীয়মান হয়। মুসলিম মানসের এই আকাঙ্ক্ষা পরবর্তী পর্যায়ের মুসলিম সাহিত্যসেবীদের স্বতন্ত্র ও নতুন চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে। এ পর্যায়ের কাব্য ও কথাসাহিত্যে সমাজ ও জীবনের পরিচয় ফুটে ওঠে; আর চিন্তা-চেতনা ও যুক্তিনির্ভর অভিব্যক্তি ঘটে প্রবন্ধসাহিত্যে। মুসলিম মানসে যুক্তিবাদী মননচর্চার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা তিরিশের কালে ঢাকায় মুসলিম সাহিত্য সমাজএর প্রতিষ্ঠা। এই সমাজের মুখপত্র শিখা পত্রিকার নামে পরিচিত ‘শিখাগোষ্ঠী’ বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন করে সাহিত্য-ভাবনার সম্পূর্ণ নতুন তরঙ্গ সৃষ্টি করে। শিখাগোষ্ঠীর প্রাণপুরুষ ছিলেন আবুল হুসেন (১৮৯৬-১৯৩৮) এবং প্রধান লেখক কাজী আবদুল ওদুদ (১৮৯৪-১৯৭০)।
ভারত বিভাগের পরে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে এবং তারও অনেক পরে স্বাধীন বাংলাদেশে যে স্বতন্ত্র সাহিত্যধারা গড়ে ওঠে, তার প্রাক্প্রস্ত্ততি হিসেবে যাঁদের অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, তাঁদের একজন হলেন মোহাম্মদ নজিবর রহমান (১৮৬০-১৯২৩)। তিনি ঔপন্যাসিক হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। তাঁর শ্রেষ্ঠ উপন্যাস আনোয়ারায় (১৯১২) তৎকালীন মুসলিম বাঙালি পরিবারের আদর্শ চিত্রায়িত হয়েছে। এটি বহুকাল বাংলার মুসলমানদের ঘরে-ঘরে পঠিত হয়েছে। তাঁর অন্যান্য রচনাও জীবনঘনিষ্ঠ। সাহিত্যে অবদানের জন্য নজিবর রহমান ‘সাহিত্যরত্ন’ উপাধিতে ভূষিত হন। একরামুদ্দীন আহমদ (১৮৭২-১৯৪০) ছিলেন এ যুগের শক্তিমান লেখকদের অন্যতম। সমালোচক, ঔপন্যাসিক ও ছোটগল্পকার হলেও তিনি সমধিক পরিচিত ছিলেন তাঁর রবীন্দ্র-প্রতিভা গন্থের (১৯২৬) জন্য। এর মাধ্যমে তিনি সর্বপ্রথম রবীন্দ্রনাথকে মুসলমান সমাজে পরিচিত করান। বাংলার মুসলমান নারীদের শিক্ষা ও প্রগতির অগ্রদূত এবং সমাজ সংস্কারকরূপে খ্যাত বেগম রোকেয়া (১৮৮০-১৯৩২) ছিলেন একজন প্রথম শ্রেণির সাহিত্যিক। তিনি উপন্যাস, ছোটগল্প, প্রবন্ধ ও কবিতা রচনায় অসাধারণ প্রতিভার পরিচয় দেন। নারীর দুঃখ-দুর্দশা নিয়ে প্রাঞ্জল ও মর্মস্পর্শী ভাষায় রচিত তাঁর অবরোধবাসিনী (১৯২৮) এক অসাধারণ রচনা। কাজী ইমদাদুল হক (১৮৮২-১৯২৬) প্রসিদ্ধি অর্জন করেন তাঁর আবদুল্লাহ (১৯৩২) উপন্যাসের জন্য। পাশ্চাত্য শিক্ষার ফলে বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে যে নবজীবন সঞ্চারিত হয় তা এতে চিত্রিত হয়েছে। শাহাদাৎ হোসেন (১৮৯৩-১৯৫৩) একজন নিরহঙ্কার সাহিত্যসাধক ও কবি হিসেবে খ্যাত। রূপছন্দা (১৯৪৩) তাঁর শ্রেষ্ঠ কাব্য। গোলাম মোস্তফার (১৮৯৭-১৯৬৪) সাহিত্যচর্চার ব্যাপ্তি বিভাগপূর্ব কাল থেকে পূর্ব পাকিস্তান পর্যায়েও বিস্তৃত। বাংলা সাহিত্যে ইসলামি ভাবধারার রূপায়ণ ছিল তাঁর সাহিত্যসাধনার প্রধান লক্ষ্য। রবীন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথ এবং পরবর্তীকালে নজরুলের দ্বারা প্রভাবিত হয়েও তিনি তাঁর মৌলিকত্ব বজায় রাখেন। গোলাম মোস্তফার সেরা রচনা বিশ্বনবী (১৯৪২) রসুলুল্লাহ্ (সঃ)-র শ্রেষ্ঠ জীবনী গ্রন্থগুলির অন্যতম। এ গ্রন্থে তাঁর গদ্যবৈশিষ্ট্য চূড়ান্তরূপ লাভ করেছে।
এ পর্যায়ে উল্লেখযোগ্য আরও কয়েকজন হলেন মোহাম্মদ আকরাম খাঁ, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ (১৮৮৫-১৯৬৯), মোহাম্মদ লুৎফর রহমান (১৮৮৯-১৯৩৬), এস ওয়াজেদ আলী (১৮৯০-১৯৫১), ইব্রাহীম খাঁ (১৮৯৪-১৯৭৮), নুরুন্নিসা খাতুন বিদ্যাবিনোদিনী (১৮৯৪-১৯৭৫), শেখ মুহম্মদ ইদরিস আলী (১৮৯৫-১৯৪৫), আকবরউদ্দীন (১৮৯৫-১৯৭৯), আবুল কালাম শামসুদ্দীন (১৮৯৭-১৯৭৮), কাজী মোতাহার হোসেন (১৮৯৭-১৯৮১), মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ্ (১৮৯৮-১৯৭৪), আবুল মনসুর আহমদ (১৮৯৮-১৯৭৯), বেনজীর আহমদ (১৯০৩-১৯৮৩), আবুল ফজল (১৯০৩-১৯৮৩), মোতাহের হোসেন চৌধুরী (১৯০৩-১৯৫৬), মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন (১৯০৪-১৯৮৭), আবদুল কাদির (১৯০৬-১৯৮৪), বন্দে আলী মিয়া (১৯০৬-১৯৭৯), মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা (১৯০৬-১৯৭৭), হবীবুল্লাহ বাহার চৌধুরী (১৯০৬-১৯৬৬), মাহবুবউল আলম (১৯০৬-১৯৮২), মুহম্মদ এনামুল হক (১৯০৬-১৯৮২), সুফী মোতাহার হোসেন (১৯০৭-১৯৭৫), বেগম সুফিয়া কামাল (১৯১১-১৯৯৯), রওশন ইজদানী (১৯১৭-১৯৬৭) প্রমুখ।
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন এবং পাশাপাশি পাকিস্তান আন্দোলন বাংলাভাষী জনগোষ্ঠীকে দুটি ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে প্রভাবিত করে। পুরানো ঐতিহ্য ও প্রথায় বিশ্বস্ত থেকেও এ পর্বের কবি-সাহিত্যিকগণ নতুন রাষ্ট্রের (১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের ফলে) পরিবর্তিত সমাজ ও জীবন-ভাবনায় উজ্জীবিত হন। তাই হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের প্রাচীন ও নবীন সাহিত্যিকদের মধ্যে জীবন ও জগৎ এবং সমাজ ও পরিবেশের নব মূল্যায়নের প্রয়াস লক্ষ করা যায়। সাহিত্যিকগণ নতুন রাষ্ট্রের সৃষ্টি, তার নতুন সমাজব্যবস্থা এবং জীবনের নবচেতনায় উদ্দীপিত হন। এর ফলে বাংলা সাহিত্যও দুটি ভিন্ন ধারায় প্রবাহিত হয়। [মহাম্মদ দানীউল হক]
বাংলাদেশ পর্ব সময়ের পরিমাপে বাংলাদেশের বাংলা সাহিত্যের বয়স পঞ্চাশ অতিক্রান্ত হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে গড়ে ওঠা বাংলা সাহিত্য নানা দিক থেকে উল্লেখযোগ্য। বিগত পঞ্চাশ বছরের সাহিত্যকে তার মৌল প্রবণতা এবং সেই প্রবণতার নিয়ন্ত্রণকারী সামাজিক-রাজনীতিক কার্যকারণকে বিভাজন রেখা হিসেবে বিবেচনা করে তিনটি পর্বে ভাগ করা যায়: প্রথম পর্ব (১৯৪৭-১৯৫৭), দ্বিতীয় পর্ব (১৯৫৮-১৯৭০) এবং তৃতীয় পর্ব (১৯৭১-)।
প্রথম পর্ব এই পর্ব দেশবিভাগের পর থেকে আইয়ুবি শাসনের পূর্ব পর্যন্ত বিস্তৃত। ১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের অব্যবহিত পরেই বাঙালি ও পূর্ববাংলা (পূর্ব পাকিস্তান) নানামুখী সমস্যার সম্মুখীন হয়। দেশবিভাগজনিত উদ্বাস্ত্ত সমস্যা, অর্থনৈতিক দুর্দশা, সাম্প্রদায়িক সমস্যা ইত্যাদির সঙ্গে ছিল পূর্ববাংলা ও বাংলা ভাষার প্রতি পাকিস্তানি শাসকদের বিরূপ মনোভাব। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার অল্পকাল মধ্যেই এদেশের মানুষ ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থার অসারতা বুঝতে পারে। পাকিস্তানিরা পূর্ববাংলাকে তাদের একটি উপনিবেশ বিবেচনা করে শাসকসুলভ মানসিকতায় বাংলার পরিবর্তে একমাত্র উর্দুকেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করতে চায়। কিন্তু বাংলা ভাষার প্রতি অবিচল শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার কারণে বাঙালিরা এর বিরুদ্ধে আন্দোলন করে, যার ধারাবাহিকতায় আসে বাহান্নর ভাষা আন্দোলন। এর ফলে বাঙালিরা স্বাধীকার চেতনার যে শক্তি অর্জন করে তার মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠে বাংলা সাহিত্যের প্রথম পর্ব।
উপন্যাস এ পর্বে বাংলাদেশে যে উপন্যাসগুলি রচিত হয় তার ভিত নির্মিত হয়েছিল বিভাগপূর্ব মুসলিম ঔপন্যাসিকদের রচনায়। তাঁদের মধ্যে মোহাম্মদ নজিবর রহমান, কোরবান আলী, শেখ ইদরিস আলী, কাজী ইমদাদুল হক, কাজী আবদুল ওদুদ, আকবরউদ্দীন, আবুল ফজল, হুমায়ুন কবির প্রমুখের নাম বিশেষভাবে স্মরণযোগ্য। বিশ শতকের প্রথম দুই দশকের বাঙালি মুসলমান সমাজের চিন্তাচেতনাকে ধারণ করে এঁরা নির্মাণ করেন বাংলাদেশের উপন্যাসের ভিত্তিভূমি।
প্রথম পর্বের অধিকাংশ উপন্যাসই রচিত হয় গ্রামবাংলার বৃহত্তর পটভূমিতে। গ্রামীণ জীবন ও তার সমস্যা-সম্ভাবনাকে উপজীব্য করে রচিত এই সময়ের কয়েকটি স্মরণীয় উপন্যাস হলো সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র লালসালু (১৯৪৮); কাজি আফসারউদ্দীনের চর-ভাঙ্গা চর (১৯৫১), শামসুদ্দীন আবুল কালামের কাশবনের কন্যা (১৯৫৪) ও আলম নগরের উপকথা (১৯৫৪), আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর চন্দ্রদ্বীপের উপাখ্যান (১৯৫২), আবু ইসহাকের সূর্য-দীঘল বাড়ী (১৯৫৫), সরদার জয়েনউদ্দীনের আদিগন্ত প্রভৃতি। এছাড়া ইসহাক চাখারী, আকবর হোসেন, দৌলতুন্নেসা প্রমুখ ঔপন্যাসিকও উল্লিখিত সময়ে উপন্যাস রচনায় সক্রিয় ছিলেন। এঁদের উপন্যাসগুলি মূলত গ্রামকেন্দ্রিক।
১৯৪৭-৫৭ কালপর্বে গ্রামীণ জীবন ও তার স্বরূপ অনুসন্ধান যেমন উপন্যাসের একটি প্রধান প্রবণতা, তেমনি মধ্যবিত্তের জীবনজিজ্ঞাসা ও জীবনসংকটকেও কেউ কেউ উপন্যাসের বিষয় করেছেন। এই শ্রেণির উপন্যাসের মধ্যে আবুল ফজলের জীবন পথের যাত্রী (১৯৪৮) ও রাঙ্গা প্রভাত (১৯৫৭) উল্লেখযোগ্য।
ছোটগল্প বিভাগপূর্বকালে বাঙালি মুসলমানদের অনেকেই উপন্যাস রচনায় মনোনিবেশ করলেও ছোটগল্প রচনায় সকলে আগ্রহী ছিলেন না। আধুনিকমনস্ক জীবনবোধের অভাবই তাঁদেরকে ছোটগল্প রচনায় বিরত রেখেছিল। তখন যাঁরা ছোটগল্প রচনায় সক্রিয় ছিলেন তাঁদের মধ্যে আবুল ফজল, আবু রুশদ, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্, আবুল মনসুর আহমদ, শামসুদ্দীন আবুল কালাম এবং শওকত ওসমান উল্লেখযোগ্য। দেশবিভাগের পরে মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণির যে বিকাশ ঘটে তাকে কেন্দ্র করেই ছোটগল্পের ভুবন গড়ে ওঠে এবং অধিকাংশ গল্পের পটভূমি ওই মুসলিম মধ্যবিত্ত সমাজ থেকেই গৃহীত হয়। বাংলা ছোটগল্পের আবহমান ধারাকে ধারণ করে দেশজ জীবনবোধ ও প্রবল সমাজচেতনা নিয়ে গড়ে ওঠে বাংলাদেশের ছোটগল্প। গ্রামীণ ও নাগরিক জীবনের রূঢ়তা এবং বাস্তবের অনুপুঙ্খ চিত্রায়ণই ছিল এ পর্বের গল্পের মুখ্য উদ্দেশ্য। তাছাড়া নাগরিক জীবনের অভিঘাত গ্রামীণ জীবনের নিস্তরঙ্গ ব্যবস্থা কীভাবে ভেঙ্গে দিচ্ছিল তার চিত্রও পাওয়া যায়। শওকত ওসমানের পিজরাঁপোল (১৯৫০), জুনু আপা ও অন্যান্য গল্প (১৯৫২), সাবেক কাহিনী (১৯৫৩); শামসুদ্দীন আবুল কালামের অনেক দিনের আশা (১৯৫২), পথ জানা নেই (১৯৫৩), ঢেউ (১৯৫৩); শাহেদ আলীর জিবরাইলের ডানা (১৯৫৩); আলাউদ্দিন আল আজাদের জেগে আছি, ধান কন্যা (১৯৫১), মৃগনাভি (১৯৫৫) প্রভৃতি এ পর্বের উল্লেখযোগ্য গল্পগ্রন্থ।
কবিতা দেশবিভাগের আগে থেকেই পূর্ববাংলার কবিরা কলকাতাকেন্দ্রিক কবিতার ধারাকে পরিহার করে নিজস্ব চিন্তাচেতনার প্রকাশ ঘটিয়ে কবিতা রচনার প্রয়াস চালিয়ে আসছিলেন। দেশবিভাগের পর নতুন দেশের নতুন পটভূমিতে স্বচ্ছন্দে এদেশের কবিবৃন্দ কবিতা রচনার চেষ্টা করেন। যাঁরা তখন কবিতার সূচনা করেন তাঁদের মধ্যে ফররুখ আহমদ (১৯১৮-১৯৭৪), আহসান হাবীব (১৯১৮-১৯৮৩), আবুল হোসেন (জ. ১৯২১), গোলাম কুদ্দুস এবং সৈয়দ আলী আহসান (জ. ১৯২২) প্রধান।
দেশবিভাগের পরে ইসলামের প্রাথমিক যুগের ইতিহাসকে অবলম্বন করে রোম্যান্টিক ভাবধারা-সম্পন্ন কবিতা রচনার প্রবণতা প্রকট হয়ে ওঠে। এর পাশাপাশি পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদ নিয়ে রচিত কবিতাও বিশেষ স্থান দখল করে। এ ভাবধারার প্রধান কবি ছিলেন ফররুখ আহমদ। ধর্মীয় বিশ্বাসকে কবিতার আবেগে রূপান্তরিত করে তিনি সার্থক কাব্যজগৎ সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন। তাঁর রচিত সাত সাগরের মাঝি (১৯৪৪), সিরাজাম মুনীরা (১৯৫২) প্রভৃতি এ পর্বের উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ। একই বিষয়ে রচিত গোলাম মোস্তফার বনি আদম (১৯৫৮) ও তালিম হোসেনের দিশারী (১৯৫৬) এ সময়ের দুটি গুরুত্বপূর্ণ কাব্যগ্রন্থ। এছাড়া সৈয়দ আলী আহসান, মুফাখখারুল ইসলাম, ছদরুদ্দীন, সুফী জুলফিকার হায়দার প্রমুখ ছিলেন উল্লিখিত সময়ের প্রধান প্রধান কবি।
এ পর্বে ধর্মীয় এবং পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদের পরিবর্তে সাধারণ মানুষ, দেশের মাটি ও প্রকৃতিকে নিয়ে বিশেষ এক ধরনের কবিতা রচনার চেষ্টা হয়, যেগুলিকে অসাম্প্রদায়িক ও মানবতাবাদী ধারার কবিতা হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। সেগুলির মধ্যে আশরাফ সিদ্দিকীর বিষকন্যা (১৯৫৫), সাত ভাই চম্পা (১৯৫৫), উত্তর আকাশের তারা (১৯৫৮), মাযহারুল ইসলামের মাটির ফসল (১৯৫৫), মতিউল ইসলামের সপ্তকন্যা (১৯৫৭), বেগম সুফিয়া কামালের মন ও জীবন (১৯৫৭) প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
দেশবিভাগের অব্যবহিত পরে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণিকে আশ্রয় করে কবিতায় আরেকটি ধারা গড়ে ওঠে। এ ধারার কবিরা কবিতায় নিয়ে আসেন একটি অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি। তাঁরা দেশজ উত্তরাধিকারকে তাঁদের কবিতার প্রধান উপাদান করে তোলেন; তাঁরা বিশ্বাস করতে শুরু করেন বাংলা সাহিত্যের প্রবহমান ঐতিহ্যকে। ফলে কবিতা-রচনায় ও জীবনদর্শনে তাঁরা হয়ে ওঠেন মানবতাবাদী। তাঁদের মুখপত্র হিসেবে ১৯৫০ সালে আশরাফ সিদ্দিকী ও আবদুর রশীদ খানের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় নতুন কবিতা। সম্পাদকদ্বয় ছাড়াও শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমান, আলাউদ্দিন আল আজাদ, বোরহানউদ্দীন খান জাহাঙ্গীর প্রমুখের কবিতায় সংকলনটি সমৃদ্ধ হয়েছিল।
একুশে ফেব্রুয়ারি এদেশের জাতীয় জীবনে যেমন, তেমনি কবিতার ক্ষেত্রেও সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে। একুশকে নিয়ে হাসান হাফিজুর রহমান ১৯৫৩ সালে একুশে ফেব্রুয়ারী নামে একটি সংকলনটি প্রকাশ করেন। তাতে পূর্বোল্লিখিত নতুন কবিতায় অন্তর্ভুক্ত অধিকাংশ কবিতাই পুনর্মুদ্রিত হয়। বাংলাদেশের কবিতার অসাম্প্রদায়িক ও মানবতাবাদী চরিত্র নির্মাণে উল্লিখিত দুটি সংকলন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ ধারার কাব্যগ্রন্থের মধ্যে আশরাফ সিদ্দিকীর তালেব মাস্টার ও অন্যান্য কবিতা (১৯৫০), আজিজুল হাকিমের বিদগ্ধ দিনের প্রান্তর প্রভৃতির নাম উল্লেখ করা যায়।
নাটক এই পর্বে সহিত্যের অন্যান্য শাখার মতো নাট্যসাহিত্য ততটা বিকাশ লাভ করে নি। নাটক সম্পর্কে ধর্মীয় ও সামাজিক নিষেধ, বিশেষত নাটকের মঞ্চায়নের ক্ষেত্রে নানাবিধ সমস্যা নাটকের বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করে। এ সময়ের অধিকাংশ নাটকই ঐতিহাসিক কাহিনী অবলম্বনে রচিত; সমকালীন জীবনবাস্তবতার কোনো স্পর্শ তাতে নেই। এ সব নাটকের মধ্যে আকবরউদ্দীনের নাদির শাহ (১৯৫৩) উল্লেখযোগ্য। লোককথাকে ভিত্তি করে কবি জসীমউদ্দীন রচনা করেন পদ্মাপার, মধুমালা ও বেদের মেয়ে। এই দুই ধারার বাইরে গিয়ে সমকালীন জীবনের একটি অনবদ্য রূপ অঙ্কিত হতে দেখা যায় নুরুল মোমেনের নেমেসিস (১৯৪৮) নাটকে। নেমেসিস বাংলাদেশের নাট্যধারার জীবনচিত্রণ ও আঙ্গিক বিবেচনায় সর্বপ্রথম সার্থক নাটক। এছাড়া রাজিয়া খানের সংবর্ত নাটকে পাওয়া যায় রাজনীতি-সচেতনতা। সামাজিক নাটক রচনার ক্ষেত্রে আশকার ইবনে শাইখের নাম বিশেষভাবে স্মরণযোগ্য। তিনি গ্রামীণ জীবনের বাস্তবতাকে কেন্দ্র করে অনেকগুলি নাটক রচনা করেন, যেমন: পদক্ষেপ, বিদ্রোহী পদ্মা, দুরন্ত ঢেউ, বিরোধ, অগ্নিগিরি, অনুবর্তন ও প্রতীক্ষা। এ নাটকগুলির রচনাকাল ১৯৫১ থেকে ১৯৫৯ পর্যন্ত। উল্লিখিত নাটকগুলিতে বিষয়-বৈচিত্র্য বিশেষভাবে লক্ষণীয়। সেখানে ঐতিহাসিক নাটকের পাশাপাশি পাওয়া যায় রাজনীতিক চেতনাসমৃদ্ধ প্রতিবাদী নাটক, লোককাহিনীভিত্তিক নাটক, কাব্য ও ব্যঙ্গ রসাত্মক নাটক। সুতরাং বিভাগপরবর্তী বাংলাদেশের নাটক মূলত ঐতিহাসিক নাটক রচনার মধ্য দিয়ে শুরু হলেও ক্রমশ তা সামাজিক বাস্তবতা এবং অন্যান্য বিষয় অবলম্বনে অগ্রসর হয়।
বাংলাদেশের নাটককে মুনীর চৌধুরী, বলা চলে প্রায় একক প্রচেষ্টায়, আন্তর্জাতিক নাট্যসাহিত্যের সমগোত্রীয় করে তোলেন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে তিনি রচনা করেন অসামান্য নাটক কবর (১৯৫৩)। নাটকটি কারাবন্দি অবস্থায় কারাগারে অভিনয়ের জন্য অপর রাজবন্দী রণেশ দাশগুপ্তের অনুরোধে রচিত হয়। বক্তব্য, আঙ্গিক ও সংলাপ রচনার দক্ষতায় এটি সমগ্র বাংলা নাটকের ক্ষেত্রে এক অনন্য সংযোজন। কবর বাংলাদেশের নাটকের ক্ষেত্রে একটি পালাবদলকারী নাটক। গ্রন্থাকারে প্রকাশের সময় কবর নাটকের সঙ্গে মানুষ ও নষ্টছেলে নাটিকা দুটিও স্থান পায়। এ তিনটি নাটকের মাধ্যমে নাট্যকার সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে একটি বৃহৎ মানবিকতায় পৌঁছানোর কথা ব্যক্ত করেন।
প্রবন্ধ বিভাগোত্তরকালে রচিত প্রবন্ধগুলির অধিকাংশই সাহিত্য ও সংস্কৃতিবিষয়ক। রচয়িতাদের অনেকেই দেশবিভাগের আগে থেকেই এ ক্ষেত্রে খ্যাতিমান ছিলেন; মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ ও মুহম্মদ আবদুল হাই-এর নাম এ প্রসঙ্গে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র লে শাঁ মিস্তিক এবং বাংলা ধ্বনিতত্ত্ববিষয়ক গ্রন্থ লে সঁ দ্যু বঁগালি ১৯২৮ সালে প্যারিস থেকে প্রকাশিত হয়। দেশবিভাগের পর এঁরা বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি নিয়ে অসাধারণ গবেষণা করেন। শহীদুল্লাহ্ রচিত বাংলা সাহিত্যের কথা (২ খন্ড ১৯৫৩, ১৯৬৫) এবং আবদুল হাই-এর সাহিত্য ও সংস্কৃতি (১৯৫৪) প্রথম পর্বের প্রবন্ধগ্রন্থের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
দ্বিতীয় পর্ব ১৯৫৮ সালে দেশে সামরিক শাসন প্রবর্তনের ফলে সাহিত্যসংস্কৃতিচর্চার ধারা বাধাগ্রস্ত হয়। প্রকাশ্য রাজনীতির ওপর নিষেধাজ্ঞা, গণতন্ত্রের অবয়বে একনায়কতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা প্রভৃতি কারণে বাঙালিদের মধ্যে ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হতে থাকে, যা এক সময় গণ-আন্দোলনের রূপ নেয়। ১৯৬৮ সালের গণঅভ্যুত্থান, ১৯৬৯ সালে ছাত্রসমাজের ১১ দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে দাবিদিবস পালন ও গণআন্দোলন, ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে বাঙালিদের নিরঙ্কুশ বিজয়, বিজয়ী দলের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর না করার ষড়যন্ত্র, পরিণতিতে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ, যুদ্ধের মাধ্যমে বাঙালিদের স্বাধীনতা অর্জন এবং স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের উদ্ভব এসব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ধারাবাহিকভাবে ঘটে। বাংলাদেশের সমাজজীবনে উল্লিখিত ঘটনাবলির প্রভাবই ১৯৫৮-১৯৭০ কালপর্বের সাহিত্যে প্রতিফলিত হয়েছে।
উপন্যাস প্রথম পর্বের মতো দ্বিতীয় পর্বেও প্রধানত গ্রামীণ জীবনকে নিয়েই উপন্যাস রচিত হতে দেখা যায়। তবে এ সময়ের উপন্যাসে মাত্রাগত পরিবর্তন যুক্ত হয়েছে, ফলে তা প্রথম পর্বের উপন্যাসের তুলনায় আলাদা। উদাহরণ হিসেবে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র চাঁদের অমাবস্যা (১৯৬৪) উপন্যাসের কথা স্মরণ করা যায়। এতে গ্রামীণ জীবনকে পটভূমি হিসেবে ব্যবহার করে ঔপন্যাসিক মূলত আইয়ুবি দশকের ধর্মভীতি ও সমরাস্ত্র-শাসিত সমাজজীবনকেই রূপায়িত করেছেন। এর পাশাপাশি প্রথম পর্বের উপন্যাসের মতো বাংলাদেশের গ্রামীণ জীবনের বাস্তবতাকে উপজীব্য করে জহির রায়হান (১৯৩৩-১৯৭২) রচনা করেন হাজার বছর ধরে (১৯৬৪)। গ্রামীণ সমাজজীবনের হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের জটিল বাস্তবতাকে কেন্দ্র করে সত্যেন সেন (১৯০৭-১৯৮১) রচনা করেন পদচিহ্ন (১৯৬৮)। নাগরিক জীবনের অভিঘাত ও জটিলতা কীভাবে দক্ষিণ বাংলার গ্রামীণ জীবনের নিরাপত্তাকে ক্রমশ বিনষ্ট করছিল তার একটি বাস্তবচিত্র অঙ্কিত হতে দেখা যায় শহীদুল্লাহ কায়সারের (১৯২৫-১৯৭১) সারেং বৌ (১৯৬২) উপন্যাসে। কর্ণফুলী নদীতীরবর্তী জনপদের শ্রমজীবী মানুষের জীবনসংগ্রাম এবং শ্রেণি-অস্তিত্বরূপ লাভ করেছে আলাউদ্দিন আল আজাদের কর্ণফুলী উপন্যাসে। আহমদ ছফার সূর্য তুমি সাথী (১৯৬৮) উপন্যাসে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জীবনসংগ্রামের চলমান রূপ বিন্যস্ত হয়েছে।
আইয়ুবি সামরিক শাসন বাঙালির জীবনচেতনা ও চিন্তাজগতে যে ছায়া ফেলেছিল, তারই প্রতিক্রিয়ায় সৃষ্টিশীল সাহিত্যিকরা বক্তব্য প্রকাশের জন্য আশ্রয় খুঁজেছিলেন মিথরূপকের জগতে, নয়তো অনুসন্ধান করেছেন ব্যক্তির গভীর মনোজগৎ। ১৯৫৮-১৯৭০ কালপর্বে বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণি যে জটিল ও বহুমুখী সঙ্কটের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়েছে, রূপকের আশ্রয়ে ওই সঙ্কটকেই শওকত ওসমান রূপ দিয়েছেন ক্রীতদাসের হাসি (১৯৬৩), রাজা উপাখ্যান (১৯৭০) ও সমাগম উপন্যাসে। একইভাবে ওল্ড টেস্টামেন্টের বুক অব দ্য প্রফেট যেরেমিয়া খন্ডের মিথরূপকের আশ্রয় নিয়ে চিরায়ত সংগ্রামী জীবনকে ফুটিয়ে তুলেছেন সত্যেন সেন তাঁর অভিশপ্ত নগরী (১৯৬৭) ও পাপের সন্তান (১৯৬৯) উপন্যাস দুটিতে। সমাজ ও সময়ের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে এবং প্রগতিশীল রাজনীতিক ভাবনা নিয়ে শামসুদ্দীন আবুল কালাম রচনা করেন ভাওয়াল গড়ের উপাখ্যান (১৯৬৩) উপন্যাসটি।
ইউরোপীয় সমাজের মধ্যবিত্তশ্রেণীর অনুসরণে এবং ব্যক্তিবোধের সূত্র ধরে অনেকেই এ পর্যায়ে রচনা করেন আধুনিক জীবনভাবনা-সম্পন্ন উপন্যাস। এসব উপন্যাসে লক্ষ করা যায় মূল্যবোধে অবিশ্বাস, প্রেমশক্তিতে অনাস্থা এবং জীবনের প্রতি প্রবল বিতৃষ্ণা। নাগরিক জীবনের ব্যক্তি-মানুষের নৈঃসঙ্গ্য এবং বিচ্ছিন্নতাকে ঔপন্যাসিকরা তাঁদের উপন্যাসের উপজীব্য করে তোলেন। এ ধরনের উপন্যাসের মধ্যে রাজিয়া খানের (জ. ১৯৩৬) বটতলার উপন্যাস (১৯৫৯) এবং অনুকল্প (১৯৫৯) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সৈয়দ শামসুল হক (জ. ১৯৩৫) এ জাতীয় উপন্যাস রচনায় সিদ্ধহস্ত। তাঁর বেশকিছু উপন্যাসে ফ্রয়েডীয় তত্ত্বকে সচেতনভাবে প্রয়োগের প্রচেষ্টা লক্ষ করা যায়। তাঁর প্রধান উপন্যাসগুলির মধ্যে রয়েছে দেয়ালের দেশ (১৯৫৯), এক মহিলার ছবি (১৯৫৯), অনুপম দিন (১৯৬২) ও সীমানা ছাড়িয়ে (১৯৬৪)।
জহির রায়হানের শেষ বিকেলের মেয়ে (১৯৬০) আপাত দৃষ্টিতে একটি রোম্যান্টিক প্রেমকাহিনী হলেও তাতে সমকালের বিকাশমান বাঙালি মধ্যবিত্তের জীবনজটিলতাকেই চিত্রিত করা হয়েছে। আলাউদ্দিন আল আজাদের তেইশ নম্বর তৈলচিত্র (১৯৬০) ও শীতের শেষ রাত বসন্তের প্রথম দিন (১৯৬২) উপন্যাসে ব্যক্তি-মানুষের সঙ্কট ও মানসিক দ্বন্দ্ব-যন্ত্রণা প্রধান হয়ে উঠেছে। অনুরূপ এক শিল্পি-দম্পতির মানসিক সঙ্কটকে নিয়ে রচিত হয়েছে কবি আহসান হাবীবের অরণ্য নীলিমা (১৯৬১) উপন্যাসটি। রশিদ করিমের প্রসন্ন পাষাণ (১৯৬৩) উপন্যাসটি প্রকৃতপক্ষে নাগরিক মধ্যবিত্তের জীবনজটিলতার এক বিশ্বস্ত দলিল। নাগরিক জীবনের উল্লিখিত প্রবণতাগুলি নিয়ে রচিত উপন্যাসের পাশাপাশি নাগরিক মধ্যবিত্তের স্থূলতা, নৈতিকতা-বর্জিত বিত্তসর্বস্বতা, রুচিবিকার ও রিরংসাবৃত্তির বিকৃতিকে কেন্দ্র করে রচিত হয়েছে শওকত আলীর পিঙ্গল আকাশ (১৯৬৩)। দিলারা হাশেমের (১৯৪৩) বৃহদায়তন উপন্যাস ঘর মন জানালা (১৯৬৫) মধ্যবিত্ত জীবনের সংগ্রাম ও ব্যর্থতাবোধের কাহিনী।
উপন্যাস রচনার উল্লিখিত প্রবণতার বাইরে গিয়ে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ রচনা করেন অসাধারণ উপন্যাস কাঁদো নদী কাঁদো (১৯৬৮)। তাঁর উপন্যাসে মধ্যবিত্ত জীবনের ক্লেদ ও সম্ভাবনা যত না ধরা পড়েছে, তার চেয়ে বেশি অঙ্কিত হয়েছে ব্যষ্টি ও সমষ্টি, মানুষের বাইরের ও ভেতরের জীবন, অস্তিত্ব ও অনস্তিত্ত্বের সংঘাত। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র চাঁদের অমাবস্যা ও কাঁদো নদী কাঁদো প্রকৃতপক্ষে বাংলা উপন্যাসের ধারায় ব্যতিক্রম।
১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের পর পূর্ববাংলার রাজনীতি এবং রাজনীতিনির্ভর জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয়গুলি বাঙালিদের চিন্তাজগতে যেমন প্রভাব বিস্তার করে, অনুরূপ প্রভাব বিস্তার করে সৃজনশীল সাহিত্যেও। বাংলাদেশের উপন্যাসে সমকালীন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রভাবও লক্ষ করা যায়। সমকালীন রাজনীতির গতিপ্রকৃতি এবং জাতীয়তাবাদী মুক্তিসংগ্রাম যে-সকল উপন্যাসে বস্ত্তনিষ্ঠভাবে ধরা পড়েছে, সেগুলির মধ্যে শহীদুল্লাহ কায়সারের সংসপ্তক (১৯৬৫), আলাউদ্দিন আল আজাদের ক্ষুধা ও আশা (১৯৬৪), সরদার জয়েনউদ্দীনের অনেক সূর্যের আশা (১৯৬৭), জহির রায়হানের আরেক ফাল্গুন (১৯৬৯), জহিরুল ইসলামের অগ্নিসাক্ষী (১৯৬৯), সত্যেন সেনের উত্তরণ (১৯৭০) এবং আনোয়ার পাশার (১৯২৮-১৯৭১) নীড়সন্ধানী (১৯৬৮) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
ছোটগল্প ষাটের দশকে বাংলা ছোটগল্প সংখ্যায় যেমন বৃদ্ধি পায়, তেমনি বৈচিত্র্যেও ঋদ্ধ হয়। নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষায় মনোযোগী হন এ পর্বের গল্পকাররা। প্রথম পর্বে যাঁরা গল্পরচনায় সক্রিয় ছিলেন তাঁরাও যেমন জীবনঘনিষ্ঠ গল্প রচনায় মনোযোগী হন, তেমনি অনেক নতুন গল্পকারেরও আবির্ভাব ঘটে। এ সময়ের গল্পকাররা তাঁদের গল্পের মাধ্যমে দরিদ্র গ্রামীণ সমাজজীবনের নানা সমস্যা বিশ্বস্ততার সঙ্গে তুলে ধরেন। এ বিষয়ক গল্পগ্রন্থগুলির মধ্যে শাহেদ আলীর একই সমতলে (১৯৬৩), সরদার জয়েনউদ্দীনের বীর কণ্ঠীর বিয়ে, নয়ান ঢুলি ইত্যাদি উল্লেখ্য। তবে গ্রামীণ জীবনচিত্রণের পাশাপাশি অনেকেই নাগরিক মধ্যবিত্তের জীবন-জটিলতা, আশা-নৈরাশ্য, কামনা-অপ্রাপ্তি, যন্ত্রণা-তৃপ্তি ইত্যাদি মানবিকবোধ নিয়ে গল্প রচনায় আগ্রহী হয়ে ওঠেন। যেসব গল্পগ্রন্থে নাগরিক মধ্যবিত্তের জীবন বিশেষভাবে প্রতিফলিত হয়েছে সেগুলির মধ্যে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর সম্রাটের ছবি (১৯৫৯), কৃষ্ণপক্ষ (১৯৫৯), সুন্দর হে সুন্দর (১৯৬০); সৈয়দ শামসুল হকের শীত বিকেল (১৯৫৯), রক্তগোলাপ (১৯৬৪), আনন্দের মৃত্যু (১৯৬৭) প্রভৃতি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
গ্রামীণ ও নাগরিক জীবনচিত্রণের সাধারণ প্রবণতার বাইরে সমাজ-বাস্তবতাকে মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে অবলোকন ও চিত্রণের চেষ্টা করেছেন আলাউদ্দিন আল আজাদ। তাঁর অধিকাংশ গল্পেই শ্রেণিসংঘর্ষের নির্মম পরিণতি প্রকাশিত হয়েছে। কিন্ত তিনি মার্কসবাদী ও দ্বান্দ্বিক বস্ত্তবাদের অনুসারী হলেও রোম্যান্টিকতায় ছিল তাঁর প্রবল উৎসাহ। ফলে এই দ্বিবিধ মানসিকতা সব সময়ই তাঁর গল্পকে বক্তব্যের দিক দিয়ে দ্বিধাবিভক্ত করে রেখেছে, যার প্রমাণ পাওয়া যায় জেগে আছি, ধানকন্যা (১৯৫১), অন্ধকার সিঁড়ি (১৯৫৮), যখন সৈকত (১৯৬৭) প্রভৃতি গ্রন্থে। বোরহানউদ্দীন খান জাহাঙ্গীরও মার্কসবাদী দৃষ্টিতে জীবনকে দেখার চেষ্টা করেছেন। তবে আলাউদ্দিন আল আজাদের মতো তিনি প্রত্যক্ষভাবে গল্পের কাঠামো ও বিষয়ে মার্কসবাদের প্রয়োগ ঘটাননি, তিনি মার্কসবাদী হয়েও পরোক্ষ ও নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে জীবন রূপায়ণে আগ্রহী। তাঁর অধিকাংশ গল্পের ঘটনা ও চরিত্র গৃহীত হয়েছে নাগরিক মধ্যবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণি থেকে। ফলে মধ্যবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণির জীবনসংগ্রামই তাঁর গল্পের মূল উপজীব্য। বোরহানউদ্দীন খান জাহাঙ্গীরের উপর্যুক্ত মানসিকতা ধরা পড়ে তাঁর দূরদূরান্ত (১৯৬৮), অবিচ্ছিন্ন (১৯৬৯) ও বিশাল ক্রোধ (১৯৬৯) গল্পগ্রন্থে।
কবিতা এ পর্বেও ইসলাম ধর্ম অবলম্বনে কেউ কেউ কবিতা রচনা করেছেন, যেমন ফররুখ আহমদের হাতেম তা‘য়ী (১৯৬৬), রওশন ইজদানীর খাতামুন নবীঈন (১৯৬০), তালিম হোসেনের শাহীন (১৯৬২), সুফী জুলফিকার হায়দারের ফের বানাও মুসলমান (১৯৫৯) ইত্যাদি। ১৯৬৫ সালে পাকভারত যুদ্ধের সময় কবিরা স্বদেশপ্রেম, জাতীয় গৌরব ও সাম্প্রদায়িক বৈরিভাবকে কবিতার বিষয় করে তুলেছিলেন। তবে যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলে এ ধরনের কবিতা রচনার প্রয়াস ক্রমশ কমতে থাকে; জনপ্রিয় হয় মানবতাবাদে আস্থাশীল কবিতা রচনার ধারা। প্রেম, প্রকৃতি ও মানুষকে নিয়ে সরল রোম্যান্টিক ভাবোচ্ছ্বাস-সম্পন্ন কবিতাই হয়ে ওঠে ওই সময়ের প্রধান কাব্যধারা। যাঁদের রচনায় ওই প্রবণতা সবচেয়ে বেশি প্রকাশিত হয়েছিল তাঁদের মধ্যে সৈয়দ আলী আহসানের উচ্চারণ (১৯৬৮), শামসুর রাহমানের বিধ্বস্ত নীলিমা (১৯৬৭), মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের বিপন্ন বিষাদ (১৯৬৮), হাসান হাফিজুর রহমানের অন্তিম শরের মত (১৯৬৮), আল মাহমুদের কালের কলস (১৯৬৬), শহীদ কাদরীর উত্তরাধিকার (১৯৬৮), ফজল শাহাবুদ্দীনের আকাঙ্ক্ষিত অসুন্দর (১৯৬৯), সৈয়দ শামসুল হকের বিরতিহীন উৎসব, আবদুল মান্নান সৈয়দের জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ (১৯৬৬) প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও মোহাম্মদ মাহফুজুল্লার জুলেখার মন (১৯৫৯), কাদের নওয়াজের নীল কুমুদী (১৯৬০), মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকার মন ও মৃত্তিকা (১৯৬০) ইত্যাদি কাব্যগ্রন্থের নাম উল্লেখ করা যায়।
এর পাশাপাশি আরও এক ধরনের কবিতা বেশ প্রভাব বিস্তার করেছিল ওই সময়, যেগুলি সমকালীন জীবনের গ্লানি, ব্যর্থতা ও হতাশাকে ধারণ করে বুর্জোয়া মানবতাবাদের সমস্যা, দ্বন্দ্ব ও অবক্ষয়কে প্রকাশ করেছে। শামসুর রাহমানের প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে (১৯৬০) ও রৌদ্র করোটিতে (১৯৬৩) এ ধারার দুটি উল্লেখযোগ্য কাব্য। অন্য যেসব কাব্য এ ধারার অন্তর্ভুক্ত সেগুলি হলো আবদুল গণি হাজারীর সামান্য ধন (১৯৬১) ও সূর্যের সিঁড়ি, সৈয়দ শামসুল হকের একদা এক রাজ্যে (১৯৬১), সৈয়দ আলী আহসানের অনেক আকাশ (১৯৬১) ও একক সন্ধ্যায় বসন্ত (১৯৬২), হাসান হাফিজুর রহমানের বিমুখ প্রান্তর (১৯৬৩), আল মাহমুদের লোক লোকান্তর (১৯৬৩) এবং আহসান হাবীবের সারা দুপুর (১৯৬৪)।
ওই সময় আরও এক ধারার কবিতা রচিত হয়েছে যাতে ধরা পড়েছে পূর্ববাংলার ইতিহাস-ঐতিহ্য ও প্রকৃতিভিত্তিক কবিমনের বিশেষ রূপ। এ ধরনের কবিতায় দেখা যায় বিশেষ আবেগ ও অনুভূতি নিয়ে কবিরা বাংলাদেশের দিকে তাকিয়েছেন; স্বদেশপ্রেম ওই সকল কবিতায় প্রধান সুর হিসেবে ধ্বনিত হয়েছে। সানাউল হকের সম্ভবা অনন্যা (১৯৬২) ও সূর্য অন্যতর (১৯৬৩) কাব্যগ্রন্থদ্বয়ে ওই মনোভাব বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয়। এ কবিতার ধারাবাহিকতায়ই পরবর্তীকালে বাংলাদেশের কবিতায় বাঙালি জাতীয়তাবোধের প্রতিফলন ঘটতে থাকে।
আলাউদ্দিন আল আজাদের মানচিত্র (১৯৬১) ও হোসনে আরার মিছিল (১৯৬৪) এ সময়ের দুটি কবিতার বই। এতে সমাজের অত্যাচারিত মানুষের পক্ষ অবলম্বন করে কবিতা লিখেছেন তাঁরা। দুজনই কবিতাকে সমাজ বদলের হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনা করেছেন এবং মার্কসবাদ তাঁদের চিন্তার মূল চালিকাশক্তি। এ সময় মার্কসবাদকে নিয়ে আরও অনেকে কবিতা রচনা করেছেন।
এ সময়ের বাংলা কবিতা ক্রমশ সমষ্টির ভাবনায় উচ্চকিত হয়ে ওঠে। নির্দিষ্ট কোনো রাজনীতিক বা সামাজিক আদর্শে বিশ্বাসী না হয়েও কবিবৃন্দ পূর্ববাংলার মানুষের সমষ্টিগত বোধ ও আবেগকে ভাষা দেওয়ার চেষ্টা করেন। সৈয়দ শামসুল হকের বৈশাখে রচিত পংক্তিমালা (১৯৬৯), শামসুর রাহমানের নিজ বাসভূমে (১৯৭০), আল মাহমুদের সোনালী কাবিন ও নির্মলেন্দু গুণের প্রেমাংশুর রক্ত চাই (১৯৭০) কাব্যগ্রন্থের মধ্যে এ ধরনের চেতনার পরিচয় পাওয়া যায়। এ সকল কাব্যগ্রন্থের মূল বিষয়বস্ত্ত এদেশের জনজীবনের দুর্দশা, জাতীয় স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা, জাতিগত নির্যাতন ও নিষ্পেষণ এবং তার প্রতিবাদ। কবিরা ব্যক্তির দুর্দশাকে ছাড়িয়ে সমষ্টির স্বপ্নকে রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানই বাংলাদেশের কবিতায় এ পালাবদল ঘটিয়েছিল। অভ্যুত্থানের কারণে কবিতায় শব্দ ব্যবহারের ধরণও পাল্টে যায়; কারণ আন্দোলনের দিনগুলিতে মিছিল, ধর্মঘট, হরতাল, শ্লোগান, সান্ধ্য আইন, পুলিশ-মিলিটারি প্রভৃতি শব্দের সঙ্গে প্রতিনিয়ত এদেশের মানুষের পরিচয় ঘটে। ফলে ওইসব শব্দ অনায়াসেই কবিতায় ঢুকে পড়ে, যার ফলে বাংলাদেশের কবিতা শব্দসম্পদের দিক দিয়ে একটি নতুন সম্ভাবনার সূচনা করে এবং পৌঁছে যায় গণজীবনের একেবারে কাছাকাছি।
নাটক সমকাল ও সমসমাজকে কেন্দ্র করে বাংলা নাটকের যে চর্চা প্রথম পর্বে শুরু হয়েছিল, দ্বিতীয় পর্বে তার বিকাশ ঘটে। এ পর্বে নাটক হয়ে ওঠে বৈচিত্র্যময় ও নিরীক্ষাধর্মী। তুলনামূলকভাবে এ সময়ের নাটকে সামাজিক বাস্তবতার নাট্যরূপ দানের প্রচেষ্টা বেশি দেখা দেয়; প্রকাশিত হয় মুনীর চৌধুরীর বিখ্যাত কয়েকটি নাটক, যার মধ্যে মৌলিক নাটকের পাশাপাশি রূপান্তরিত নাটকও রয়েছে। মুনীর চৌধুরীর দন্ডকারণ্য (১৯৬৬) সমকালীন জীবন থেকে বিষয়বস্ত্ত নিয়ে রচিত। তাঁর চিঠি নাটকটিও সাধারণ বিষয়বস্ত্তকে কেন্দ্র করে ব্যঙ্গ ও বিদ্রূপের মাধ্যমে হাস্যরস সৃষ্টির উদ্দেশ্যে রচিত। ঐতিহাসিক বিষয় নিয়ে রচিত হলেও মুনীর চৌধুরীর রক্তাক্ত প্রান্তর সমকালীন যুদ্ধবিরোধী মানসিকতার এক অসাধারণ নাট্যরূপায়ণ। মুনীর চৌধুরীর মতো ঐতিহাসিক বিষয় নিয়ে সিকান্দার আবু জাফরও রচনা করেন সিরাজউদ্দৌলা (১৯৬৫) ও মহাকবি আলাউল (১৯৬৬); তবে দুটি নাটকই জীবনবোধের গভীরতা ও বক্তব্যে কেবল ইতিহাসের অংশ না হয়ে সমকালীন জীবনের অংশ হয়ে উঠেছে। শওকত ওসমানও সমকালীন সমাজ নিয়ে নাটক রচনায় আগ্রহী হয়েছিলেন। তাঁর আমলার মামলা, তস্কর লস্কর, কাঁকর মণি ও এতিমখানা সমকালীন সামাজিক বিষয় অবলম্বনে রচিত নাটক।
বাংলাদেশের নাট্যসাহিত্যে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ একটি বিশিষ্ট নাম। তিনিই প্রথম নাট্যকার যিনি বাংলা নাটকে ইউরোপীয় নাটকের রুচি ও প্রকরণ নিয়ে আসেন। তাঁর রচিত বহিপীর ও তরঙ্গভঙ্গ (১৯৬৪) বাংলাদেশের নাট্যসাহিত্যে ভিন্নধর্মী সংযোজন। তাঁর মতোই আধুনিক দর্শন ও শিল্পতত্ত্বের সাহায্য নিয়ে বিশ্বমানের নাটক রচনা করে বাংলা নাটককে সমৃদ্ধ করেন সাঈদ আহমদ। তাঁর কালবেলা (১৯৬২) ও মাইলপোস্ট (১৯৬৪) বিশ্বনাটকের মানের সঙ্গে তুলনীয়; আঙ্গিক কুশলতায়ও এসব নাটক অভিনব ও নিরীক্ষাধর্মী।
শ্রেণিদ্বন্দ্বকে নাটকের বিষয় হিসেবে নির্বাচন করে আলাউদ্দিন আল আজাদ রচনা করেন মায়াবী প্রহর (১৯৬৯); কিন্তু মরোক্কোর যাদুঘর (১৯৫৯) নাটকে তিনি দক্ষতার সঙ্গে রূপকের আশ্রয়ে আধুনিক জীবনের সমস্যাকে রূপায়িত করেন। একই রকম রূপক নাটক রচনায় কৃতিত্বের পরিচয় দেন সিকান্দার আবু জাফর। তাঁর শকুন্ত উপাখ্যান (১৯৬৮) একটি অনন্যসাধারণ রূপক নাটক। জিয়া হায়দার রচিত শুভ্রা সুন্দর কল্যাণী আনন্দ (১৯৭০), আবদুল্লাহ আল-মামুনের শপথ (১৯৬৫) মূলত প্রতীকী নাটক। এছাড়া উল্লিখিত সময়ে যাঁরা নাট্য রচনায় উৎসাহী হয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে আনিস চৌধুরী, নীলিমা ইব্রাহীম, আ.ন.ম বজলুর রশীদ, ইব্রাহিম খলিল, কল্যাণ মিত্র প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।
প্রবন্ধ এ পর্বের প্রবন্ধে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস সম্পর্কেই বেশি গবেষণা হয় এবং তাতে বাঙালি মুসলমান লেখকগণ প্রাধান্য লাভ করেন। এ সময়ের উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলি হলো নাজিরুল ইসলাম মোহাম্মদ সুফিয়ানের বাঙ্গালা সাহিত্যের নতুন ইতিহাস, আবদুল লতিফ চৌধুরীর বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, মুহম্মদ এনামুল হকের মুসলিম বাঙ্গালা সহিত্য, মুহম্মদ আবদুল হাই ও সৈয়দ আলী আহসানের বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত, কাজী দীন মুহম্মদের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস ও মুহম্মদ মনসুরউদ্দীনের বাংলা সাহিত্যে মুসলিম সাধনা।
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস নিয়ে চর্চার পাশাপাশি বাংলা ভাষা নিয়েও একাধিক লেখক এপর্বে গ্রন্থ রচনা করেছেন। তাঁদের মধ্যে মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র বাঙ্গালা ভাষার ইতিবৃত্ত, মুহম্মদ আবদুল হাই-এর ধ্বনিবিজ্ঞান ও বাংলা ধ্বনিতত্ত্ব, শিবপ্রসন্ন লাহিড়ীর সিলেটি ভাষাতত্ত্বের ভূমিকা ইত্যাদি গ্রন্থের নাম উল্লেখ করা যায়।
বাংলা সাহিত্যে মুসলমান লেখকদের অবদান নিয়ে একাধিক গ্রন্থ রচিত হয়েছে স্বাধীনতাপূর্ব বাংলাদেশে। এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থগুলি হলো অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য, কাজী আবদুল মান্নানের আধুনিক বাংলা সাহিত্যে মুসলিম সাধনা, মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহর বাংলা কাব্যে মুসলিম ঐতিহ্য, মুস্তাফা নূরউল ইসলামের মুসলিম বাংলা সাহিত্য, গোলাম সাকলায়েনের মুসলিম সাহিত্য ও সাহিত্যিক, পূর্ব-পাকিস্তানের সুফী সাধক প্রভৃতি।
এ পর্বে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ রচিত হয়েছে এবং সেগুলি হলো মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর রবি পরিক্রমা, আনোয়ার পাশার রবীন্দ্র ছোটগল্প সমীক্ষা, যোগেশচন্দ্র সিংহের ধ্যানী রবীন্দ্রনাথ, আনিসুজ্জামান সম্পাদিত রবীন্দ্রনাথ, সৈয়দ আকরম হোসেনের রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস: দেশকাল ও শিল্পরূপ, আহমদ কবিরের রবীন্দ্রকাব্য: উপমা ও প্রতীক, হুমায়ুন আজাদের রবীন্দ্রনাথ: রাষ্ট্র ও সমাজচিন্তা প্রভৃতি।
পুথিসাহিত্য সম্পাদনার ক্ষেত্রে স্বাধীনতাপূর্বকালে অনেকেই আগ্রহী হয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে আলাওলের পদ্মাবতী কাব্যটির পাঠ সম্পাদনা ও সমালোচনা করেন মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, সৈয়দ আলী আহসান ও আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ। পরবর্তীকালে সম্পাদনামূলক কর্মে প্রধানত মুসলমানদের রচিত পুথি সম্পাদনাই প্রাধান্য পায়। এক্ষেত্রে যাঁরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন তাঁদের মধ্যে আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ, আহমদ শরীফ, এনামুল হক প্রমুখের নাম স্মরণযোগ্য। আহমদ শরীফ সম্পাদনা করেন দৌলত উজির বাহরাম খানের লায়লী-মজনু (১৯৫৮), আলাওলের তোহফা (১৯৫৮), মহম্মদ খানের সত্যকলি-বিবাদ-সংবাদ বা যুগ সংবাদ (১৯৫৯), জয়েনউদ্দীনের রসুলবিজয় (১৯৬৪) ইত্যাদিসহ পনেরোটিরও অধিক পুথি। এছাড়া মযহারুল ইসলাম ও মুহম্মদ আবদুল হাফিজের সম্পাদনায় দৌলত কাজীর সতীময়না ও লোরচন্দ্রানী (১৯৬৯), রাজিয়া সুলতানার সম্পাদনায় নওয়াজীস খানের গুলে বকাওলী (১৯৭০) এই পর্বের পুথি সম্পাদনার ক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
সমাজ, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ে স্বাধীনতাপূর্বকালে যাঁরা মৌলিক প্রবন্ধ রচনা করেছেন তাঁদের মধ্যে কাজী দীন মুহম্মদের সাহিত্য-সম্ভার ও সাহিত্যশিল্প, আহমদ শরীফের বিচিত চিন্তা, মযহারুল ইসলামের সাহিত্য পথে উল্লেখযোগ্য। সাহিত্যের বিষয়গত সমালোচনামূলক প্রবন্ধ বাংলা ভাষায় যত রচিত হয়েছে, তার আঙ্গিক নিয়ে আলোচনা ও সমালোচনায় প্রাবন্ধিকরা ততটা উৎসাহ দেখাননি। এ ক্ষেত্রে সৈয়দ আলী আহসান পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেন। তাঁর রচিত কবিতার কথা কিংবা আধুনিক কবিতা: শব্দের অনুষঙ্গে গ্রন্থদুটি সাহিত্যের আঙ্গিক আলোচনায় বিশেষভাবে স্মরণীয়। এছাড়া সৈয়দ আলী আশরাফের কাব্য পরিচয়, রণেশ দাশগুপ্তের উপন্যাসের শিল্পরূপ এ ধারায় বিশেষ মূল্যবান সংযোজন।
তৃতীয় পর্ব উপন্যাস এ পর্বের উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধ, যুদ্ধের নারকীয়তা, তার মধ্য দিয়ে সুন্দর বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখা এবং পরে স্বাধীনতা অর্জন সব কিছুই স্থান পেয়েছে। সৈয়দ শামসুল হক এ পর্বে যেসব উপন্যাস রচনা করেছেন তাতে ধরা পড়েছে স্বাধীনতা-উত্তর গ্রামজীবনের জটিল ও বহুমাত্রিক দ্বন্দ্ব। তাঁর দূরত্ব (১৯৮১) উপন্যাসে কলেজ শিক্ষক জয়নালের জীবনকথায় পঁচাত্তর-পরবর্তী বাংলাদেশের সামাজিক-রাজনৈতিক জীবনের জটিল বাস্তবতার চিত্র ধরা পড়েছে অত্যন্ত বিশ্বস্ততার সঙ্গে। তাঁর মহাশূন্যে পরান মাস্টার (১৯৮২) ও আয়না বিবির পালা (১৯৮২) উপন্যাস দুটিতেও গ্রামজীবনের পরিবর্তন ও তার ভাঙ্গনের চিত্র অঙ্কিত হয়েছে।
স্বাধীনতার অব্যবহিত পরবর্তী কয়েক বছরের অস্থিরতা ও সমাজ-রাজনীতির চিত্র উপস্থাপিত হয়েছে হাসনাত আবদুল হাই রচিত তিমি (১৯৮১) উপন্যাসে। সমুদ্রতীরবর্তী কাজলপুর ইউনিয়নের মানুষেরা কীভাবে সকল প্রকার অপশক্তির বিরুদ্ধে নিজেদের অস্তিত্বের সংগ্রামে জয়ী হয় তার বিশ্বস্ত চিত্র অঙ্কিত হয়েছে এ উপন্যাসে। প্রায় একই রকম চিত্র পাওয়া যায় তাঁর প্রভু (১৯৮৬) উপন্যাসে। স্বাধীনতা-উত্তর গ্রামীণ জীবনের সংঘাত ও অস্তিত্বজিজ্ঞাসার এক চমৎকার শব্দরূপ সৃষ্টি হয়েছে বশীর আল হেলালের শেষ পানপত্র (১৯৮৬) উপন্যাসে।
আঞ্চলিক জীবনের পটভূমিকায় সেলিনা হোসেন মানুষের বেঁচে থাকার চিরকালীন লড়াইকে চিত্রিত করেছেন জলোচ্ছ্বাস (১৯৭২) ও পোকামাকড়ের ঘরবসতি (১৯৮৬) উপন্যাসে। এ ধরনের আরও দুটি রচনা হলো আবু বকর সিদ্দিকের জলরাক্ষস (১৯৮৫) ও খরদাহ (১৯৮৭)। স্বাধীনতা-পরবর্তী গ্রামীণ জীবনের বিনষ্টির যে চিত্র উল্লিখিত উপন্যাসগুলিতে পাওয়া যায়, তার বিপরীতে গ্রামীণ জীবনের ইতিবাচক পরিবর্তনের চিত্র পাওয়া যায় হরিপদ দত্তের ঈশানে অগ্নিদাহ (১৯৮৬) ও অন্ধকূপে জন্মোৎসব (১৯৮৭) উপন্যাস দুটিতে।
দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে যে বিশাল মধ্যবিত্তশ্রেণী স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল, তাদের একটি বড় অংশ স্বাধীনতার পরে দেশের আর্থ-সামাজিক-রাজনীতিক অস্থিরতা ও অব্যাহত বিশৃঙ্খলা দেখে হতাশ হয়ে পড়ে; ফলে শুরু হয় তাদের স্বপ্নভঙ্গের পালা। ১৯৭১ পরবর্তী উপন্যাসে মধ্যবিত্ত-জীবনের সেই হতাশা ও স্বপ্নভঙ্গের চিত্রই অঙ্কিত হয়েছে। সরদার জয়েনউদ্দীনের শ্রীমতি ক ও খ এবং শ্রীমান তালেব আলি (১৯৭৩) এমন একটি উপন্যাস, যেখানে স্বাধীনতা-পরবর্তী বাঙালি জীবনের সামগ্রিক অবক্ষয়ের চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। যুদ্ধ-পরবর্তী জীবনের হতাশাকে পরিপূর্ণভাবে চিত্রিত না করলেও হুমায়ুন আহমদের নন্দিত নরকে (১৯৭২) ও শঙ্খনীল কারাগার (১৯৭৩) উপন্যাস দুটিতে মধ্যবিত্ত জীবনের পরিবর্তনহীনতা এবং পারিবারিক বৃত্তের মধ্যে সংঘটিত ব্যর্থতা ও নিঃসঙ্গতাকে রূপ দেওয়া হয়েছে। আর সমাজবিচ্ছিন্ন ব্যক্তির আত্মসুখ খুঁজে ফেরা ভোগবাদী মানসিকতার চিত্ররূপ দেখতে পাওয়া যায় সৈয়দ শামসুল হকের খেলারাম খেলে যা (১৯৭৩) উপন্যাসে। এর বিপরীতধর্মী উপন্যাস রচনা করেন সুকান্ত চট্টোপাধ্যায়। তাঁর রচিত একজন (১৯৭৫) উপন্যাসের নায়ক যৌনসমস্যার পরিবর্তে মনের সমস্যায় জর্জরিত। রশিদ করীমের প্রেম একটি লাল গোলাপ (১৯৭৮) ও সাধারণ লোকের কাহিনী (১৯৮১) উপন্যাসেও মধ্যবিত্তের জীবনের বহুমুখী সঙ্কট চিত্রিত হয়েছে। অন্যদিকে রিজিয়া রহমানের রক্তের অক্ষর (১৯৭৮) উপন্যাসে নগরজীবনের অন্ধকারাচ্ছন্ন, বীভৎস ও পাশব হিংস্রতায় জর্জরিত পতিতাপল্লীর জীবন চিত্রিত হতে দেখা যায়। তাঁর একটি ফুলের জন্য (১৯৮৬) উপন্যাসে পাওয়া যায় একজন মুক্তিযোদ্ধার পরাজয়ক্লিষ্ট মুখচ্ছবি। এ জাতীয় আরও রচনা শওকত আলীর অপেক্ষা (১৯৮৫), বশীর আল হেলালের কালো ইলিশ (১৯৭৯), হাসনাত আবদুল হাই-এর আমার আততায়ী (১৯৮০), সেলিনা হোসেনের মগ্নচৈতন্যে শিস (১৯৭৯) ইত্যাদি। অন্যদিকে বাংলাদেশের উপন্যাস সাহিত্যের অপর একজন শক্তিমান লেখিকা রাজিয়া খানের হে মহাজীবন (১৯৮৩) উপন্যাসে দেখা যায় মুক্তিকামী এক নারীর জীবনচিত্র। একই ধরনের চেতনা নিয়ে তিনি রচনা করেন চিত্রকাব্য (২ খন্ড ১৯৮০, ১৯৮৭) উপন্যাস।
শামসুর রাহমানের অক্টোপাশ (১৯৮৩) ও মন্তাজ (১৯৮৫) উপন্যাস বাইরের ও ভেতরের চাপে ব্যক্তির অন্তর্গত রক্তক্ষরণের লেখ্যরূপ। এ ধরনের উপন্যাসের মধ্যে আবু জাফর শামসুদ্দীনের পদ্মা মেঘনা যমুনা (১৯৭৪), সংকর সংকীর্তন (১৯৮০) এবং স্বাধীনতা-পূর্ববর্তী রচনা ভাওয়াল গড়ের উপাখ্যান মিলে একটি ট্রিলজি সৃষ্টি হয়েছে। একইভাবে ১৯৪৭ থেকে ১৯৫২ কালপর্বের ঘটনা-প্রবাহকে নিরাসক্তভাবে মূল্যায়ন করা হয়েছে সরদার জয়েনউদ্দীনের বিধ্বস্ত রোদের ঢেউ (১৯৭৫) উপন্যাসে। ভাষা আন্দোলনের মৌল আবেগের শব্দরূপ হিসেবে গড়ে উঠেছে শওকত ওসমানের আর্তনাদ (১৯৮৫) ও সেলিনা হোসেনের যাপিত জীবন (১৯৮১) উপন্যাসের কাহিনী। একই সঙ্গে এতে উঠে এসেছে দেশবিভাগজনিত উদ্বাস্ত্তসমস্যা এবং সাংস্কৃতিক সংকটও। ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে আশ্রয় করে রচিত শওকত আলীর প্রদোষে প্রাকৃতজন (১৯৮৪) এক অনন্য সংযোজন। বাঙালির নৃতাত্ত্বিক-ভৌগোলিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক জীবনের দীর্ঘ পরিসরে গড়ে উঠেছে রিজিয়া রহমানের বং থেকে বাংলা (১৯৭৮), একাল চিরকাল (১৯৮৪) এবং সেলিনা হোসেনের নীল ময়ূরের যৌবন (১৯৮৩) ও চাঁদ বেনে (১৯৮৪) উপন্যাস।
স্বাধীনতা-উত্তরকালে রাজনীতি-সচেতনতা, সেনাতন্ত্র, ধর্মতন্ত্র এবং যুদ্ধাপরাধী পুনর্বাসনের মধ্য দিয়ে যে জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিরাজমান ছিল, তার মূল্যায়ন ও বিশ্লেষণকে কেন্দ্র করে রচিত হয়েছে একাধিক উপন্যাস। সেগুলির মধ্যে শওকত ওসমানের পতঙ্গ পিঞ্জর (১৯৮৩) এবং সেলিনা হোসেনের নিরন্তর ঘণ্টাধ্বনি (১৯৮৭) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আর ষাটের দশকের ব্যক্তি ও সমষ্টির স্বপ্নকল্পনা ও রাজনীতিক অভীপ্সা নিয়ে রচিত হয়েছে শওকত আলীর ত্রয়ী উপন্যাস দক্ষিণায়নের দিন (১৯৮৫), কুলায় কালস্রোত (১৯৮৬) ও পূর্বরাত্রি পূর্বদিন (১৯৮৬)। ষাটের দশকেরই আরেক প্রভাববিস্তারী ঘটনা অর্থাৎ ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানকে অবলম্বন করে রচিত হয়েছে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের চিলেকোঠার সেপাই (১৯৮৬) উপন্যাসটি।
মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে রচিত উপন্যাসের মধ্যে প্রথমেই উল্লেখযোগ্য আনোয়ার পাশার আত্মজৈবনিক রীতিতে রচিত রাইফেল রোটি আওরাত (১৯৭৩)। একই বিষয় অবলম্বনে শওকত ওসমান রচনা করেন চারটি উপন্যাস: জাহান্নম হইতে বিদায় (১৯৭১), দুই সৈনিক (১৯৭৩), নেকড়ে অরণ্য (১৯৭৩) এবং জলাংগী (১৯৭৬)।
কবিতা স্বাধীনতা-উত্তর কবিতাকে এক কথায় মুক্তিযুদ্ধের কবিতা বলা চলে, কারণ এ সময়ের কবিতায় বিশেষভাবে মুক্তিযুদ্ধ এবং যুদ্ধের আবেগ ও অভিজ্ঞতা ধরা পড়েছে। পাকিস্তান আমলের শেষ দিকে রচনা শুরু করেও যাঁরা স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের কবিতায় সক্রিয় ছিলেন তাঁদের মধ্যে আবদুল মান্নান সৈয়দ, আবদুল্লাহ আবু সাঈদ, রফিক আজাদ, মোহাম্মদ রফিক, জিনাত আরা রফিক, আলতাফ হোসেন, আসাদ চৌধুরী প্রমুখ প্রধান। এঁদের পরে যাঁরা তীব্র আবেগ, দ্রোহ আর প্রেমের কবিতা রচনা করেছেন তাঁদের মধ্যে নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহা, হুমায়ুন আজাদ, দাউদ হায়দার, হুমায়ুন কবীর প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। এঁদের কবিতা অনেক বেশি জীবনঘনিষ্ঠ এবং মাটি ও মানুষের কাছাকাছি। এ সময়ের কবিতা ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখ বা বেদনাবোধের পরিবর্তে সমষ্টির চেতনাকে অধিক রূপায়িত করেছে। কবিতার চিরচেনা ভাব ও ভাষাকে বাদ দিয়ে এঁরা অনমনীয় ও বিষয়নির্ভর কবিতা রচনার প্রতি মনোযোগী হয়েছেন।
স্বাধীন দেশের মুক্ত পরিবেশে সাহিত্যের অন্যান্য শাখার তুলনায় কবিতাই হয়ে ওঠে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শাখা। কিন্তু স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মানুষ যা প্রত্যাশা করেছিল, তা বাস্তবায়নের কোনো সম্ভাবনা না দেখে আশাহত ও বঞ্চনার বেদনায় মুষড়ে পড়েন এদেশের সাধারণ মানুষের মতো কবিরাও। এর বহিঃপ্রকাশ ঘটে দাউদ হায়দারের ‘জন্মই আমার আজন্ম পাপ’, রফিক আজাদের ‘ভাত দে হারামজাদা তা না হলে মানচিত্র খাবো’ ইত্যাদি কবিতায়। স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি এবং দুর্ভিক্ষ জর্জরিত জীবন নিয়ে রচিত কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রফিক আজাদের ভাত দে হারামজাদা, দাউদ হায়দারের জন্মই আমার আজন্ম পাপ এবং রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহর বাতাসে লাশের গন্ধ উল্লেখযোগ্য।
স্বাধীনতা উত্তর কবিতার আরেকটি প্রধান বিষয় প্রেম। রাজনৈতিক চিন্তাভাবনার পাশাপাশি কবিদের রচনায় চিত্তের বৈভবটিও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। নবীন কবিদের পাশাপাশি প্রবীণ কবিদেরও অনেকেই প্রেমবিষয়ক কাব্যগ্রন্থ প্রকাশে উদারতার পরিচয় দিয়েছেন। প্রেম ও বিপ্লবকে তাঁরা সমার্থক বিবেচনা করে তাঁদের কাঙ্ক্ষিত ভুবনকে পাওয়ার জন্য আকুল হয়েছেন। এ কারণে স্বাধীনতা পরবর্তীকালে বিপ্লবী কবিতার পাশাপাশি অজস্র প্রেমের কবিতাও রচিত হয়েছে।
কিন্তু বাংলাদেশের কবি ও কবিতা কখনোই প্রেমসর্বস্ব হয়ে থাকেনি। দেশের শাসনব্যবস্থায় গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে যখন সামরিক স্বৈরাচার ক্ষমতাসীন, তখনও কবিরা নিজেদের হতাশা, ক্ষোভ ও প্রতিবাদ ব্যক্ত করতে দ্বিধাগ্রস্ত হননি। তবে এক্ষেত্রে তাঁরা হয় পুরান নয়তো রূপকের আশ্রয়ে তাঁদের বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন। এ ধরনের রূপকধর্মী কাব্য হিসেবে শামসুর রাহমানের উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক কবিতা রচনার পাশাপাশি স্বাধীনতা পরবর্তীকালে একদল কবি কবিতাকে নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। তাঁরা রচনা করেছেন পরাবাস্তব কবিতা। এ প্রসঙ্গে আবদুল মান্নান সৈয়দের পরাবাস্তব কবিতা গ্রন্থটির নাম বিশেষভাবে স্মরণীয়। তবে কবিতা রচনার এ ধারা দীর্ঘদিন স্থায়ী হয়নি। এর পাশাপাশি আবার কেউ কেউ কবিতার ছন্দ ভেঙ্গে এর আঙ্গিকের ক্ষেত্রে নানারকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছেন। অবশ্য এরকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা সব সময়ই ছিল এবং বর্তমানেও অব্যাহত রয়েছে।
আশির দশকের কবিতা মূলত প্রতিবাদী চেতনায় পূর্ণ। তখন বাংলাদেশে চলছিল সামরিক স্বৈরাচার ও ক্ষমতালোভীদের শাষণ-শোষণ; তাই সরাসরি দ্রোহের প্রকাশ ঘটেছে সে সময়ের কবিতায়। আশির দশকের কবিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যরা হলেন খন্দকার আশরাফ হোসেন, মোহন রায়হান, মারুফ হোসেন, সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ প্রমুখ।
নববইয়ের দশকে নতুন একটি চেতনা বাংলাদেশের কবিতাজগতকে আন্দোলিত করে। এ দশকের কবিরা সচেতনভাবে উত্তর-আধুনিকতার চর্চা শুরু করেন। মূলত লিটল ম্যাগাজিনগুলিকে কেন্দ্র করে দেশীয় ঐতিহ্যের নানা বিষয় নিয়ে তাঁরা ফিরে তাকান আদি ও প্রকৃত বাংলাদেশের দিকে। তিরিশের কবিরা বাংলা কবিতায় যে আধুনিকতার সূত্রপাত করেছিলেন, আবহমান বাংলা কবিতার সঙ্গে তার কোন যোগসূত্র ছিল না; কারণ তা ছিল একটি আরোপিত বিষয়। ওই আরোপিত আধুনিকতার খোলস থেকে বাংলা কবিতাকে বের করে যথার্থ বাংলা ভাষা ও বাংলাদেশের কবিতা করে তোলাই উত্তরআধুনিক কবিদের প্রচেষ্টা।
ছোটগল্প স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের ছোটগল্পে আবু জাফর শামসুদ্দীন, আবু রুশদ, শওকত ওসমান, আলাউদ্দিন আল আজাদ প্রমুখ খ্যাতি অর্জন করেন। আবু জাফর শামসুদ্দীনের রাজেন ঠাকুরের তীর্থযাত্রা (১৯৭৭) বিবৃতিমূলক ছোটগল্পের সঙ্কলন। আবু রুশদের মহেন্দ্র মিষ্টান্ন ভান্ডার (১৯৮৬) গ্রন্থে কয়েকটি দুঃসাহসী এবং চমৎকার গল্প সন্নিবেশিত হয়েছে। স্বাধীনতা উত্তরকালে সৈয়দ শামসুল হক উপন্যাস ও নাটক রচনায় অধিকতর মনোযোগী হলেও তাঁর একটি উৎকৃষ্ট গল্পগ্রন্থ প্রাচীন বংশের নিঃস্ব সন্তান বাংলাদেশের গল্পের ধারায় বিশেষ উল্লেখযোগ্য। আবুল খায়ের মুসলেহউদ্দীন এবং নাজমুল আলম স্বাধীনতা পরবর্তীকালে লোকজ জীবনবৃত্তের আলেখ্য নিয়ে গল্প রচনা করেন। অন্যদিকে সাঙ্কেতিক গল্প রচনা করেন সাইয়িদ আতীকুল্লাহ্ তাঁর বুধবার রাতে (১৯৭৩) গ্রন্থে।
এ সময়ের ছোটগল্প স্বাধীনতা পূর্বযুগের তুলনায় অনেক বেশি গণমুখী ও রাজনীতি সংলগ্ন। মুক্তিযুদ্ধ, যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বিপুল সংখ্যক মধ্যবিত্তের স্বপ্নভঙ্গের বেদনা, গ্রামীণ ও নাগরিক জীবনের ভাঙ্গন, পারিবারিক জীবনে সুস্থিরতার অভাব ইত্যাদি বার বার ওঠে এসেছে এ সময়ের গল্পে। স্বাধীনতা-পরবর্তী ছোটগল্পে সক্রিয় লেখকদের অনেকেই সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন, ফলে যুদ্ধের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় তাঁরা অনেকেই ছিলেন সমৃদ্ধ। হানাদার বাহিনীর নির্যাতন-নিপীড়ন ও গণহত্যার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মানুষের সশস্ত্র প্রতিরোধ ও যুদ্ধ গল্পকারদের অনুপ্রেরণার উৎস। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক প্রথম গল্প সংকলন আবদুল গাফফার চৌধুরীর বাংলাদেশ কথা কয় (১৯৭১) প্রকাশিত হয় কলকাতা থেকে। সংকলনে অন্তর্ভুক্ত গল্পগুলির মধ্যে ধরা পড়েছে মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা। পরে ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয় বশীর আল হেলালের প্রথম কৃষ্ণচূড়া (১৯৭২), আবুল হাসনাত সম্পাদিত মুক্তিযুদ্ধের গল্প (১৯৭৩) এবং হারুন হাবীব সম্পাদিত মুক্তিযুদ্ধের নির্বাচিত গল্প (১৯৮৫)।
মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীন বাংলাদেশের সামাজিক অস্থিরতা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, যুবসমাজের নৈতিক অবনতি এবং সামগ্রিকভাবে মূল্যবোধের চরম অবক্ষয়কে বিষয়বস্ত্ত করে একাধিক গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। এ ধরনের গল্পগ্রন্থের মধ্যে শওকত ওসমানের জন্ম যদি তব বঙ্গে (১৯৭৫), আলাউদ্দিন আল আজাদের আমার রক্ত, স্বপ্ন আমার (১৯৭৫), আবদুল মান্নান সৈয়দের মৃত্যুর অধিক লাল ক্ষুধা (১৯৭৭) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের ছোটগল্পে একটি বড় পরিবর্তন হচ্ছে জীবনদৃষ্টির পরিবর্তন। সমাজের উঁচু তলার মানুষের পাশাপাশি নিচুতলার মানুষও গল্পের বিষয়বস্ত্ত হিসেবে স্থান লাভ করে। এ প্রসঙ্গে আল মাহমুদের পানকৌড়ির রক্ত (১৯৭৩) উল্লেখযোগ্য। এটি সাধারণ মানুষের কামনা-বাসনার উন্মুখ চিত্রসম্বলিত একটি অনিন্দ্যসুন্দর গল্পগ্রন্থ। বাংলা ছোটগল্পের ইতিহাসে এমন লালসাসিক্ত গল্প খুব কম লেখকই লিখেছেন। তাঁর গল্পের পরিবেশও আমাদের এতকালের চেনাজানা পরিবেশ থেকে অনেক দূরের; জেলে-নৌকায়, বেদের বহরে, বিল কিংবা হাওরের পটভূমিতে এসব গল্প রচিত। আল মাহমুদের অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ গল্পগ্রন্থ হচ্ছে সৌরভের কাছে পরাজিত।
বাংলাদেশের নগর-সংস্কৃতি নিয়ে ছোটগল্পে গড়ে উঠেছে এক ভিন্ন ধারা। এই সংস্কৃতির দুটি প্রান্ত, যার একদিকে বিত্ত-বৈভব, অন্যদিকে নিঃস্বতা। বিত্তবানদের চিত্তদৈন্য আর নিঃস্বদের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ এই বিপরীতমুখী বিষয়কে অবলম্বন করে অনেকেই সৃষ্টি করেছেন তাঁদের গল্পের ভুবন। এরূপ প্রসঙ্গ নিয়ে রচিত রাহাত খানের অনিশ্চিত লোকালয় (১৯৭২), অন্তহীন যাত্রা (১৯৭৫) ও ভালমন্দের টাকা (১৯৮১); আবদুশ শাকুরের ক্রাইসিস (১৯৭৬), সরস গল্প (১৯৮২); রশীদ হায়দারের অন্তরে ভিন্ন পুরুষ, মেঘেদের ঘরবাড়ি; হাসনাত আবদুল হাইয়ের একা এবং এ প্রসঙ্গে, যখন বসন্ত; মাফরুহা চৌধুরীর অরণ্য গাথা ও অন্যান্য গল্প, বশীর আল হেলালের বিপরীত মানুষ, মাহবুব তালুকদারের অরূপ তোমার বাণী, আবুল হাসানাতের পরকীয়া, কবোষ্ণ, বাজ; সুব্রত বড়ুয়ার কাচপোকা, নাজমা জেসমিন চৌধুরীর অন্য নায়ক, হুমায়ুন আহমদের নিশিকাব্য, শীত ও অন্যান্য গল্প; ইমদাদুল হক মিলনের লাভ স্টোরি ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
স্বাধীনতা উত্তরকালের ছোটগল্পে সামাজিক দায়বদ্ধতা অধিক পরিমাণে প্রকাশিত হয়, কারণ সমাজে তখন নানামুখী পরিবর্তন সূচিত হচ্ছিল; রাজনৈতিক ভাঙ্গাগড়া এবং শোষণ-বঞ্চনা বৃদ্ধির কারণে সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি তেমন ঘটেনি। তবে এর মধ্য দিয়েই গজিয়ে ওঠে একটি উচ্চবিত্ত শ্রেণি। তাদের জীবনও ছোটগল্পে ঠাঁই পেয়েছে নানাভাবে। এ ধরনের গল্পগ্রন্থের মধ্যে আবু বকর সিদ্দিকের মরে বাঁচার স্বাধীনতা (১৯৭৭) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এছাড়া মঞ্জু সরকারের অবিনাশী আয়োজন (১৯৮২), হরিপদ দত্তের সূর্যের ঘ্রাণে ফেরা (১৯৮৫), সৈয়দ ইকবালের ফিরে পাওয়া (১৯৮২) প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
দারিদ্র্যক্লিষ্ট ভূমিহীন কৃষক, জোতদার ও মহাজনের শোষণ-পীড়ন, রাজনৈতিক ফড়িয়া, দালাল ও ধর্মব্যবসায়ীদের দ্বারা বিভ্রান্ত- বিপর্যস্ত গ্রামবাংলার লোকদের কথা ছোটগল্পে এসেছে চল্লিশ-পঞ্চাশ দশক থেকেই। স্বাধীনতা পরবর্তী ছোটগল্পেও এদের কথা অনেকে সহানুভূতির সঙ্গে বর্ণনা করেছেন। হাসান আজিজুল হকের গল্পে উত্তর বাংলার জনজীবনের এরূপ একটি চিত্র উপস্থাপিত হয়েছে। স্বাধীনতা পূর্বকালে তিনি লিখেছিলেন সমুদ্রের স্বপ্ন শীতের অরণ্য (১৯৬৪) এবং আত্মজা ও একটি করবী গাছ (১৯৬৯); স্বাধীনতার পরে লেখেন জীবন ঘষে আগুন (১৯৭৩), নামহীন গোত্রহীন (১৯৭৫), পাতালে হাসপাতালে (১৯৮১) প্রভৃতি। শওকত আলীর লেলিহান সাধ (১৯৭৩) ও শুন হে লখিন্দর (১৯৮৬) গ্রন্থদুটিও এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য।
আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের সকল গল্পগ্রন্থই প্রকাশিত হয়েছে স্বাধীনতার পরে। তাঁর অন্য ঘরে অন্য স্বর (১৯৭৬), খোয়ারি (১৯৮২) ও দুধভাতে উৎপাত (১৯৮৫) উল্লেখযোগ্য গল্পগ্রন্থ। তিনি পুরনো ঢাকার জীবনকে নিখুঁতভাবে তাঁর গল্পে রূপায়িত করেছেন। হাসান আজিজুল হক, শওকত আলী এবং আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের গল্পের মাধ্যমে বাংলাদেশের ছোটগল্পের যে সামাজিক ব্যবস্থা ও সমাজ-রাজনীতির চিত্র উন্মোচিত হয়েছে, তার একদিকে প্রতিষ্ঠিত শোষিত গ্রামীণ জীবন, অন্যদিকে ক্ষয়িষ্ণু মূল্যবোধ।
সাম্প্রতিক কালে যাঁরা উল্লেখযোগ্য গল্প রচনা করছেন তাঁদের মধ্যে মঈনুল আহসান সাবের (পরাস্ত সহিস), কায়েস আহমদ (অন্ধ তীরন্দাজ), বিপ্রদাশ বড়ুয়া (গাঙচিল, যুদ্ধজয়ের গল্প), বুলবুল চৌধুরী (টুকা কাহিনী), হারুন হাবীব (বিদ্রোহী ও আপন পদাবলী), ভাস্কর চৌধুরী (রক্তপাতের ব্যাকরণ), আহমেদ বশীর প্রমুখ প্রধান।
নাটক ১৯৭১ সালে বিভাষী শাসকদের হাত থেকে মুক্তি লাভের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে মুক্তসংস্কৃতিচর্চার এক অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয় এবং সেই সুবাদে নাট্যচর্চা একটি নিয়মিত শিল্পমাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। কবিতার পরে নাটকেই তখন সমাজের চিত্র অধিক মাত্রায় প্রতিফলিত হয়। তাছাড়া নাট্যকারদের উদ্ভাবনী শক্তি, রাজনীতি-সচেতনতা, কৌশলগত আঙ্গিক ও পরিশীলিত ভাষা স্বাধীনতা পরবর্তী নাটকে এক প্রাণচাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। এ সময়ের নাটকে দেখা যায় গণআন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রামের চিত্র এবং স্বাধীনতা উত্তর সমাজজীবনে মূল্যবোধের অবক্ষয়, মানুষের হতাশা-বঞ্চনা ইত্যাদি। রূপক, প্রতীক ও লোকজ ঐতিহ্যের ব্যবহারেও এ সময় বিভিন্ন নাটক রচিত হয় এবং অনেক বিদেশী নাটক বাংলায় রূপান্তরিত হয়। স্বাধীনতার পর যাঁদের রচনায় বাংলাদেশের নাট্যআন্দোলন বেগবান হয় তাঁদের মধ্যে সৈয়দ শামসুল হক, আবদুল্লাহ আল মামুন, মামুনুর রশীদ ও সেলিম আল দীন প্রধান। এঁরা সকলেই মঞ্চাভিনয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত।
সৈয়দ শামসুল হকের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক কাব্যনাটক পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় (১৯৭৬) বাংলাদেশের নাট্যক্ষেত্রে একটি মূল্যবান সংযোজন। এছাড়াও তাঁর নূরলদীনের সারা জীবন (১৯৮২), এখানে এখনও যুদ্ধ এবং যুদ্ধ ফর্মের দিক দিয়ে নাটকের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। সুবচন নির্বাসনে নাটকের মধ্য দিয়ে আবদুল্লাহ আল মামুন প্রতিষ্ঠা অর্জন করেন। এছাড়া ১৯৭৪ সালে দেশে বিরাজমান মূল্যবোধের অবক্ষয়, হতাশা, অস্থিরতা ইত্যাদি নিয়ে তিনি রচনা করেন এখন দুঃসময়, চারিদিকে যুদ্ধ, এবার ধরা দাও, সেনাপতি, এখনও ক্রীতদাস (১৯৮৪) ইত্যাদি মঞ্চসফল একাধিক নাটক।
সমসাময়িক নাট্যকারদের মধ্যে মামুনুর রশীদ সবচেয়ে বেশি সমাজসচেতন। তাঁর উল্লেখযোগ্য নাটকগুলি: ওরা কদম আলী (১৯৭৯), ওরা আছে বলেই (১৯৮১), ইবলিস (১৯৮৩), এখানে নোঙর (১৯৮৪), গিনিপিগ ইত্যাদি। সেলিম আল দীন নাটকের ফর্ম ও ভাষা নিয়ে নানারকম পরীক্ষা করেছেন। সংবাদ কার্টুন ও মুনতাসির ফ্যান্টাসিতে ব্যঙ্গধর্মী নাটক রচনায় তাঁর নাট্যপ্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায়। এছাড়া তাঁর কিত্তনখোলা (১৯৮৫), শকুন্তলা, কেরামতমঙ্গল নাটকও উল্লেখযোগ্য।
মমতাজউদ্দীন আহমদ স্বাধীনতার আগে থেকেই নাটক রচনা করলেও স্বাধীনতার পরেই তাঁর নাটকের প্রসার ঘটে। একাঙ্কধর্মী নাটক রচনায় এবং নাটকের সংলাপে ব্যঙ্গাত্মক ভাষা ব্যবহারে তাঁর একটি বিশিষ্টতা রয়েছে। স্বাধীনতার পরে রচিত তাঁর সাত ঘাটের কানাকড়ি, কী চাহ শঙ্খচিল (১৯৮৫) দুটি মঞ্চসফল নাটক।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের নাটক হয়ে ওঠে নাট্য আন্দোলনের একটি প্রধান হাতিয়ার; গড়ে ওঠে নানা নাট্যগোষ্ঠী। গোষ্ঠীগুলি নিয়মিত নাট্য মঞ্চায়নের মাধ্যমে নাটককে ক্রমশ একটি সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। যেসকল নাট্যগোষ্ঠী নাট্য-আন্দোলনে বিশেষভাবে সক্রিয় সেগুলি হলো: নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়, থিয়েটার, ঢাকা থিয়েটার, আরণ্যক, ঢাকা পদাতিক, নাট্যচক্র ইত্যাদি। এগুলি ব্রেখট্, মলিয়র, চেখভ, শেকসপীয়র, ইবসেন প্রমুখ বিশ্বখ্যাত নাট্যকারদের নাটক অনূদিত ও রূপান্তরিত করে মঞ্চস্থ করছে।
প্রবন্ধ স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে গবেষণার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হলেও মৌলিক প্রবন্ধ রচনার ক্ষেত্রে তার বিকাশ আশানুরূপ নয়। এ সময়ের প্রবন্ধ-সাহিত্যকে প্রধানত নয়টি ধারায় ভাগ করা যায়: প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় সাহিত্য, আধুনিক সাহিত্য, রবীন্দ্র-সাহিত্য, নজরুল-সাহিত্য, লোকসাহিত্য, ভাষাচর্চা, ভাষা আন্দোলনবিষয়ক সাহিত্য, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সাহিত্য এবং সম্পাদনা। এ পর্বে যাঁরা গবেষণার ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রেখেছেন তাঁরা হলেন সন্জীদা খাতুন, রফিকুল ইসলাম, আনিসুজ্জামান, আবদুল হাফিজ, আবু হেনা মোস্তফা কামাল, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, সৈয়দ আকরম হোসেন প্রমুখ। সন্জীদা খাতুন ও সৈয়দ আকরম হোসেনের গবেষণার বিষয় যথাক্রমে রবীন্দ্রসঙ্গীত এবং রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস ও ছোটগল্প। রফিকুল ইসলামের গবেষণার বিষয় নজরুল-সাহিত্য ও নজরুলসঙ্গীত। আবু হেনা মোস্তফা কামালের গ্রন্থের নাম Bengali Press and Literary Writing (১৯৭৭)। মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান নানাবিধ বিষয় অবলম্বনে গবেষণা করেছেন, তবে সেগুলির মধ্যে সাময়িকপত্রে সাহিত্যচিন্তা: সওগাত (১৯৮১) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মোহাম্মদ মনিরুজ্জমান, আনিসুজ্জামান এবং মুস্তাফা নূরউল ইসলামের রচনার মধ্য দিয়ে বংলা ভাষার সাময়িক পত্রগুলির একটি চরিত্র পাঠকের সামনে উন্মোচিত হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে গবেষণার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য কাজ করেছেন গোলাম মুরশিদ। তাঁর গবেষণার বিষয় সমাজ সংস্কার আন্দোলন ও বাংলা নাটক; রশীদ আল ফারুকি কাজ করেছেন বাংলা সাহিত্যে মুসলিম ঔপন্যাসিকদের নিয়ে। আবুল কাশেম চৌধুরী সামাজিক নকশার পটভূমি ও প্রতিষ্ঠা, নাজমা জেসমিন চৌধুরী বাংলা উপন্যাসে রাজনীতি এবং ওয়াকিল আহমদ উনিশ শতকের বাঙালি মুসলমানের চিন্তাচেতনার ধারা বিষয়ে গবেষণা করেছেন। এ থেকে একটি বিষয় পরিষ্কার হয়ে ওঠে যে, স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশে গবেষণার ক্ষেত্রে বৈচিত্র্যের ছোঁয়া লেগেছে।
লোকসাহিত্য ও ভাষাতত্ত্ব নিয়েও বাংলাদেশে ব্যাপক গবেষণা হয়েছে। লোকসাহিত্য বিষয়ে উল্লেখযোগ্য গবেষণা করেছেন আবুল কালাম মোহাম্মদ জাকারিয়া, আশরাফ সিদ্দিকী, মযহারুল ইসলাম, আবদুস সাত্তার, আবদুল হাফিজ, আনোয়ারুল করীম, খোন্দকার রিয়াজুল হক, এস.এম লুৎফর রহমান, আবুল আহসান চৌধুরী প্রমুখ। আর ভাষাতত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করেছেন মোহাম্মদ আবদুল কাইয়ুম, রফিকুল ইসলাম, আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ, মনসুর মুসা, হুমায়ুন আজাদ, দানীউল হক, মনিরুজ্জামান প্রমুখ।
রাজনৈতিক, সমাজতাত্ত্বিক ও মননশীল রচনার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্যরা হচ্ছেন বদরুদ্দীন ওমর, আবদুল হক, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, আবুল কাশেম ফজলুল হক, আহমদ রফিক প্রমুখ। মৌলিক গবেষণামূলক প্রবন্ধ-সাহিত্যে রণেশ দাশগুপ্ত, সৈয়দ আলী আহসান, কবির চৌধুরী, আবদুল মান্নান সৈয়দ, সৈয়দ আকরম হোসেনের অবদান গুরুত্বপূর্ণ। এঁদের মধ্যে রণেশ দাশগুপ্ত মার্কসবাদী প্রাবন্ধিক হিসেবে খ্যাত। সৈয়দ আলী আহসান অতীত ও বর্তমান বাংলা কবিতা এবং শিল্পকলা সম্পর্কে প্রচুর প্রবন্ধ লিখেছেন। তাঁর সতত স্বাগত, শিল্পবোধ ও শিল্পচৈতন্য গভীর অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন প্রবন্ধ গ্রন্থ। কবির চৌধুরী মূলত বিদেশী লেখক ও তাদের রচনাকর্মের সঙ্গে বাঙালি পাঠকদের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রেই বিশেষ কৃতিত্ব অর্জন করেন। [আমীনুর রহমান]
গ্রন্থপঞ্জি মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, বাংলা সাহিত্যের কথা (১ম-২য় খন্ড), ঢাকা, ১৯৬৭, ১৯৭৬; মুহম্মদ আবদুল হাই ও সৈয়দ আলী আহসান, বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত, চট্টগ্রাম, ১৯৬৮; সুকুমার সেন, বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস (১ম-৪র্থ খন্ড), ইস্টার্ন পাবলিশার্স, কলকাতা, ১৯৭০-৭৬; অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত (১ম-৫ম খন্ড), ৪র্থ সংস্করণ, কলকাতা, ১৯৮২-৮৫; আহমদ শরীফ, বাঙালী ও বাঙলা সাহিত্য (১ম-২য় খন্ড), ঢাকা, ১৯৭৮, ১৯৮৩; দীনেশচন্দ্র সেন, বঙ্গভাষা ও সাহিত্য (অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত), কলকাতা, ১৯৮৬।